পুরুষতন্ত্র এবং আমাদের দায়
মনিরা সুলতানা মুন্নী ।। আমি খুব সহজ, হয়তো অতি সহজ, কিন্তু আমি চাই না কোনো মানসিক এবং শারীরিক দীনতায় ভোগা অমানবের হীনমন্য আস্ফালন আমার ছায়াকেও স্পর্শ করার স্পর্ধা করুক। আমি গড়পরতায় পড়া, আবার কখনও গোনায় ধরার অযোগ্য; কিন্তু আমি চাই না আমার শিরদাঁড়ায় ঘুন বাসা বাঁধার স্বপ্ন দেখুক। তার আগে আমি সহস্রবার মৃত্যুকে বরণ করতে চাই হাসি মুখে। আমার জীবনের চরম অবস্থায় আমি পরাজয় মেনে নিতে চাই না। আমি চাই আমার মতো করে বাঁচতে। আমার সম্মান, ইচ্ছে, প্রয়োজন, দুঃখ-সুখ, চাওয়া-পাওয়া, জয়-পরাজয় ও আমার জেদ আমার হয়ে থাক। আমার মতো করে আমাকে যে মেনে নিতে না পারে, আমাকে যে তার মতামতে পরিচালনা করার কথা ভাবে সে আমার সহস্র জনম দূরে থাক।
আমরা নারী তাই আমাদের রাতের আঁধারে গলা কেটে ফেলার অধিকার পুরুষের আছে। সেই ক্ষমতা আমরাই তাদের দিয়েছি। আমরা শিখেছি নারী দুর্বল, আমরা শিখিয়েছি নারী দুর্বল। আমরা নিজেকে উপস্থাপন করি ভোগের বস্তু হিসেবে। আমরা ভালো সাজি আর ভালো সাজতেই প্রশ্রয় দিই পুরুষের হীনমন্য রুচির। আমরা যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়াই পুরুষতন্ত্রের জঘন্য নিয়ম। সেটাকেই ধর্ম মানি। আমরা নিজেকে সম্মান দিতে পারি না তাই আমাকে পরিচালিত হতে হয় অন্যের মস্তিষ্ক দিয়ে। আমরা নিজেকে স্বাধীন করি না, আমরা সহজ পথ খুঁজি অন্যের ঘাড়ে পা তুলে খাওয়ার। আমরা চরম অপমানকে সোহাগ করে নাম দিই “অধিকারবোধ”। দিনের পর দিন আমরা মাথায় করে রাখি পুরুষের করা অসম্মান। আমরা গর্ব করে বলি, কতো যন্ত্রণা সহ্য করেও সংসারে টিকে আছি। মূর্খ মেয়েমানুষ এটা গর্বের নাকি চরম অপমানের সেটাই ক’জন বুঝি? সমাজের কাছে ভালো সাজতেই আমরা টিকিয়ে রাখি পঁচে যাওয়া সম্পর্ক। আমরা সুযোগ করে দিই। কখনো কখনো গলা পেতে দিই। আহ্বান করি, আসো আমার গলা কাটো, আমি কলি যুগের সতী! আমরা জানিই না কোনটা আমাদের সম্মান কোনটা আমাদের মর্যাদা। দিনের পর দিন শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে, খুন করতে যাওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছে তাও আমরা তাকে আদিখ্যেতা করে বলছি – ‘‘ওর রাগ বেশি’’। এটা আমাদের কর্মফল নয়?
ছোট থেকে যখন একটা মেয়ে বড় হয়, তাকে একটি মাত্র উদ্দেশ্য বড় করা হয়। উদ্দেশ্যটা হচ্ছে “বিয়ে”। এবং এই বিয়ে দিয়েই বাবা মা মনে করেন তাদের দায়িত্ব শেষ। এই মেয়েটির সংসার না টিকলে ফিরে আসার কোনো দুয়ার খোলা থাকে না বরং বলা ভালো খোলা রাখে না। এর পরও যদি কেউ চলেও আসে সমাজ তাকে অস্পৃশ্য করে রাখে। নানান রঙের নানান ঢঙের নাম দেয়। আমি এখনো এমন একজন মাকে দেখিনি যে মা বলেছে “তুই না মানিয়ে নিতে পারলে ফিরে আয়, আমি তোর পাশে আছি”। শুধু এই একটি ভরসার অভাবে কত শত মেয়ে বরণ করে নিয়েছে নরক যন্ত্রণা। বিচ্ছেদকে আমরা খুব হীন চোখে দেখি। কিন্তু অসুস্থ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা মহৎ মনে করি। কোন মন্ত্রবলে এই ধারণা গেঁথে দেয়া হয়েছে আমাদের মগজে আমরা নিজেরাই জানি না। উত্তর খোঁজার পরিশ্রমও করি না। আমরা ধারণ করি যে একজন নারীকে দেখে রাখার জন্য পুরুষ মানুষের দরকার। কিন্তু আমরা এটা ধারণ করি না যে, নারী পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। কিছু কাজ পুরুষও পারে না, তাকে নারীর উপর নির্ভরশীল হতে হয়। বেশিরভাগ কাজেই হতে হয়। সেটা স্বীকার করতে পুরুষ সমাজের আঁতে ঘা লাগে। আমরা নারী স্বাধীনতাকে পুরুষতান্ত্রিকতার মাপকাঠিতে বিচার করি তাই পুরুষ মানুষের সাথে সেটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। আমরা নিজের চিন্তা দিয়ে অন্যের অধিকার নির্ধারন করি। নারীর মতামতের গুরুত্ব দিতে শিখি না তাই নারীর মতের গুরুত্ব দিই না। আমরা নারীকে তার মতো করে চলতে দিই না। সে কারণেই মাঝরাতে কোনো নারীকে বাইরে বের হতে দেখলে বাজে মন্তব্য ও সুযোগ নেয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু কয়জন আছি সেই নারীকে সুরক্ষা দেয়ার চিন্তা করি?
অভিভাবক কন্যা সন্তানের ভবিষ্যৎ বলতে বোঝে একটা বিয়ে। তাকে শিক্ষিত করে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়া, ভবিষ্যতে অন্যের দ্বারস্থ না হওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী করা, এসব ব্যাপারে অভিভাবক উদাসীন কারণ তারা জানে, যে সমাজ তারা তৈরি করেছে সেখানে নারী নিজের মুখে কথা বলতে পারে না, তার উপরে খরচ করে লাভের লাভ কিছুই তারা পাবে না। আজও শত শত মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংসার করতে হয়। অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়। কারণ তাদের আর কোন গতি নেই। সমাজে লক্ষ্মী মেয়ে, ভালো মেয়ে সেই, যে যাবতীয় কাজকর্মে নিপুণ এবং শত সহস্র নির্যাতন আহ্লাদ করে বরণ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নারী যে নির্যাতিত হচ্ছে সেই উপলব্ধিও পুরুষের থাকে না। তার অধিকার আদায় করে নিতে সে নিম্নতর অবস্থায় নামতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করে না। স্বল্প শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি স্বামীর চোখের ইশারায় কেমন পুতুলের মতো পরিচালিত হয় পুরো একটা জাতি।
একজন বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল খুব ধনীর পুত্রের সাথে। কিছু বছর যাওয়ার পরে মেয়েটার দুইটি পুত্র সন্তান হয়। হঠাৎ একদিন তার স্বামী মারা যায় হার্ট অ্যাটাকে। স্বামীর সংসারে তার আর জায়গা কোথায়? দুটি সন্তান নিয়ে সে যাবে কোথায়? লেখাপড়া নেই, কী করে জীবিকা নির্বাহ করবে?
বয়স তখন ১৭ কি ১৮। একদিন দুই বন্ধু মিলে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে বাজারে গিয়েছি। কেনাকাটা করতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় দ্রুত বড় রাস্তায় উঠলে বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি পেতে সহজ হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম আড়াআড়ি রাস্তায় যাব। কিন্তু রাস্তাটি অধিক নির্জন হওয়ায় দু বন্ধুতে হাত ধরাধরি করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম। কিছুটা পথ যাওয়ার পর পাশ থেকে একটি ছেলের বাজে মন্তব্য শুনে প্রতিবাদ করলে, পথ চলতি এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলো সন্ধ্যার পরে মেয়েদের বাইরে বের হলে এমন বাজে কথা শুনতে হয় এবং প্রতিবাদ না করে মাথা নিচু করে চলে যাওয়াই নাকি ভদ্র ঘরের মেয়েদের উচিৎ। সেদিনের সেই ভদ্রমহিলা শুধু সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকার কারণে আমাদেরই কেন দোষারোপ করেছিল আজ বুঝতে পারি এবং খুব করুণা হয় তার উপর।
একজন ব্যক্তি দূরপাল্লায় ভ্রমনের সময় পাবলিক টয়লেটের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বিরতির সময় খুব কম। নারীদের লাইন থেকে কয়েকজন নারীকে পুরুষ টয়লেটে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি পুরুষ মানুষেরা ব্যক্তিটিকে বিশেষ কিছু কথা শোনালো। তার মধ্যে একটা বাক্য এমন “সমান অধিকার চায়, এখন পুরুষ টয়লেটে আসছে কেন?”
একজন অতিপ্রিয় মানুষের সাথে কথা হচ্ছিল, বললাম – “মা অসুস্থ; রান্না খাওয়া, এমনকি মাকে দেখাশোনা করার জন্য তো একটা লোক দরকার। বিয়ে করলে পারেন!”
একজন মানুষ (পুরুষ মানুষ বললাম না), তার উত্তর ছিল ‘‘মা’তো আমার, অন্য কাউকে কেন দেবো তার দায়িত্ব?”
আমি সেদিন শুধু তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম।
এমন চিন্তার মানুষে ভরে উঠুক মেয়েদের চারপাশ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]