ভাষা, ভাষার মাস ও পৃথিবীর ভাষা
চেন রাখাইন ।। যখন ভাষার মাস আসে তখন আমার মনের গহীনে রঙ-বেরঙের অনুভূতি এসে জড়ো হয়। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ফেব্রুয়ারি মাসের এক অন্যরকম তাৎপর্য বা বিশেষত্ব রয়েছে। এই মাসেই ভাষা আন্দোলনের জন্য ভাষা শহিদেরা প্রাণ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছিল।
এই মাসটা কেন আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম কিছু কারণ হচ্ছে, বাংলাকে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রথমবার পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে উত্থাপন করেছিলেন কুমিল্লার কৃতি সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ১৯৪৮ সালের এই মাসেই অর্থাৎ ২৩ শে ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদে বাঙালির এই প্রাণের দাবিটি তুলেছিলেন। যদিও প্রথম অধিবেশনেই তাঁর দাবি পাকিস্তানিদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন সরকারের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এই মাসে মিছিল ও জনসভা করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল ভাষার দাবিতে অনড় বিদ্রোহী ছাত্র-জনতা। ‘৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতেই ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন সালাম-রফিক-বরকতসহ আরো কয়েক বাংলার দামাল ছেলেরা। আসলে পাকিস্তানি কোনো শাসকই বাংলা ভাষাকে স্বীকার কিংবা স্বীকৃতি কোনোটাই করতে ও দিতে চায়নি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী থেকে শুরু করে খাজা নাজিমুদ্দিন অথবা পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী নুরুল আমীন সরকারও না। তারা সকলেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ছিলেন। ‘৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ বাংলার বুকে প্রথম শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছিল। যদিও সেটা এর পরের দিনই ভেঙে ফেলা হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসের বিশেষত্ব ভাষা আন্দোলনেই শেষ হয়ে যায়নি। এই মাসের গুরুত্ব জুড়ে আছে ‘৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের সাথেও। বঙ্গবন্ধু ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন; যা বাংলার ম্যাগনাকার্টা নামেও পরিচিত। এই মাসটা জড়িয়ে আছে ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সাথেও। ‘৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল বিদ্রোহী জনতার উত্তাল প্রতিবাদে ভীত হয়ে। এর একদিন পরেই অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য বহির্বিশ্বের সমর্থন বা স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ‘৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যতগুলো স্ক্যান্ডিনেভিয়া দেশ, ইউরোপীয় ও অ-ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তা অন্য কোনও মাসে দেয়নি! এরকম আরো অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই মাসে সংঘটিত হয়েছে। এজন্য ফেব্রুয়ারি মাস আমার দৃষ্টিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস; যে মাসে বৃহত্তর অর্জনের পাশাপাশি হারানোর বিষাদও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেশবাসীকে সাহস দিয়েছে, শক্তি যুগিয়েছে। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে যদি পাকিস্তানি সরকার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি মেনে নিতো ও তৎকালীন পাকিস্তানি গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ যদি গোঁয়ারের মতো “Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan” এই কথাটি ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ কার্জন হলে সেই ভাঙা রেকর্ড পুনরায় না বাজাতেন; যদি তারা পূর্ব বাংলার দাবি মেনে নিতেন, তাহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির ক্ষোভ এত তীব্র হতো কি-না ঠিক জানি না কিংবা স্বাধীনতা আন্দোলনের বেগ এত ত্বরান্বিত হতো কি-না জানি না; হলেও আরো পরে হতো। তবে আমার মনে হয়, ইতিহাসের নিরিখে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিভাজন অনিবার্য ছিল। পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে; আর ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বাংলাদেশকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করে শোষণ করতে চেয়েছিল। সত্যি বলতে, কোনো দেশ পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মের ভিত্তিতে এক হতে পারেনি। যদি হতো তাহলে সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, মিশর, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক ইত্যাদি দেশগুলো মিলে একটা দেশ হতো; কিন্তু সেটা হয়নি। বরং স্বার্থগত কারণে তাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতে দেখি। ভারত ও নেপাল পাশাপাশি দুটি দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু রাষ্ট্র হলেও তারা এক হতে পারেনি। তেমনি খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোও এক হতে পারেনি। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাস এক জিনিস, আর ভাষা-সংস্কৃতি এসব ভিন্ন জিনিস। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলিম হলেও তাদের ভাষা উর্দু কিংবা আরবি না; তাদের সংস্কৃতি আরবের সংস্কৃতির সাথে মেলে না। দেশভেদে ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা হয়ে থাকে। তাই শুধুমাত্র ধর্মই একতাবদ্ধ হওয়ার প্রধান উপাদান হতে পারে না।
কাউকে নিজেদের মাতৃভাষা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভিন্ন একটি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না, আর এটা সবক্ষেত্রে সম্ভবও না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের বাংলাদেশ। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল, আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের অপচেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের অপচেষ্টা সফল হয়নি। বাঙালি ঠিকই রক্তের বিনিময়ে হলেও মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বানিয়েছিল। আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা যখন হয় তখন শুধুমাত্র তা রাজপথে হয় না; কাগজে-কলমেও আন্দোলন গড়ে উঠে, গর্জে উঠে সর্ব শক্তি নিয়ে। কবির হৃদয়ের অলিন্দ থেকে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতা বের হয়ে আসে, গীতিকারের হৃদয়ে বেজে উঠে সুরেলা গান, ঔপন্যাসিকের মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে উপন্যাসের নানা চরিত্র। ভাষা আন্দোলনের সময়ও কবি সাহিত্যিকেরা কলমের ভাষায় কাগজে প্রতিবাদের হুঙ্কার এঁকে দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী লিখেছিলেন অমর কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’; মুনীর চৌধুরী জেলে বসেই রচনা করেন, ‘কবর’ নাটকটি; জহির রায়হান লিখেন, ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসটি; আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেন মর্মস্পর্শী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো’। তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যতগুলো বই রচিত হয়েছিল, তা অন্য কোনও সময় রচিত হয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুধু দেশি সাহিত্যিকেরাই নন, বিদেশি লেখকেরাও প্রচুর বই লিখেছেন। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’র কথা তো আমরা অনেকেই জানি। তিনি ১৫১ লাইনের সেই সুদীর্ঘ কবিতাখানি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই লিখেছিলেন। কবিতাটির হৃদয়গ্রাহী কিছু লাইন ছিল এরকম—
“Millions of fathers in rain
Millions of mothers in pain
Millions of brothers in woe
Millions of sisters nowhere to go”
যখন ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিল, তখন কিন্তু শুধু বাংলা ভাষাকেই না, পৃথিবীর বাকি যতগুলো ছোট-বড় ভাষা রয়েছে, তাদেরকেও একই সাথে তাদের মাতৃভাষা উদযাপনের একটি সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। তাই এই দিবস সকল ভাষাগোষ্ঠীর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও বাংলাদেশের সব মানুষের ভাষা বাংলা না। দেশের একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা আলাদা। পাহাড়ি ও আদিবাসী অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। বৃহৎ একটি ভাষাগোষ্ঠীর পাশে যখন ক্ষুদ্র কোনও ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষজন বসবাস করে, তখন তাদের ভাষা হুমকির মুখে থাকে। একটি ভাষা কীভাবে হারিয়ে যায় সেটা নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকেরা কিছু গবেষণা করেছেন। তাদের মতে, অতীতে ভাষাসমূহ বিলুপ্তির সাধারণ কয়েকটি কারণ হচ্ছে, খুব ছোট কোনও ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা মহামারির কারণে সবাই মারা গেলে অথবা যুদ্ধে কিংবা ভূমিকম্প, বন্যা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে, তাদের সাথে তাদের ভাষাটাও হারিয়ে যায়। তবে বিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বৃহৎ জাতি-রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ছোট ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা যখন ঐতিহ্যবাহী জীবিকার মাধ্যমে নিজেদের জোগান মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন তারা প্রভাবশালী সমাজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেই বৃহত্তর সমাজের সাথে তার নিজস্ব ভাষায় যোগাযোগ করতে শিখে। তাদের মধ্যে দ্বিভাষিকতার একটি পর্ব থাকে, যার কারণে ক্ষুদ্র সমাজের সদস্যদের উভয় ভাষারই নিয়ন্ত্রণ থাকে; কিন্তু এই পর্বটি সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ পরবর্তী প্রজন্ম আস্তে আস্তে বৃহত্তর সমাজের ভাষায় একভাষিক হয়ে ওঠে। এভাবে কালক্রমে নেটিভ ভাষাটি হারিয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কথিত অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষার সাথে এমনটি ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়—
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, পাবলিক স্কুল এবং মিশন স্কুলের পক্ষ থেকে তরুণ নেটিভ আমেরিকান শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানোর জন্য একটি আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তারা বাচ্চাদের ছুটি দিত না, যাতে পরিবারের সাথে বাড়িতে গিয়ে নিজেদের ভাষা চর্চা করতে না পারে এবং নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে ইংরেজি ভাষা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারে। তবে বর্তমানে সেখানকার কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে; এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সরকার নেটিভ আমেরিকানদের সেসব ভাষা রক্ষার্থে এখন প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। ভাষাগুলো বাঁচানোর গুরত্ব তারা এখন বুঝতে পেরেছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের ভাষাগুলোর সাথে যেন এমন ভয়াবহ কাণ্ড না ঘটে, সেই জন্য সরকারকে এখনই সুদৃষ্টি দিতে হবে। শীঘ্রই ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, আমেরিকার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমাদেরও; সেই সাথে হারাতে হবে ভাষার বৈচিত্রতা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]