November 21, 2024
কলামফিচার ২

আত্মরক্ষা বনাম আত্মীয়তা

ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। 


বসন্ত এসে গেছে। প্রেমের কবিতা ঠিক আসে না। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী বড়োই গদ্যময় আর কি! তাই প্রেম নিয়ে রচনা লিখতে বসলাম। আসলে ‘প্রেম’ শব্দটাকে আপন করা মেয়েদের পক্ষে খুবই কঠিন। প্রেমের জোয়ারে ভাসতে গেলে যে বাঁধন খোলা দরকার সেই বাঁধনের জোর খুব মজবুত – ‘নারী’ শব্দের ‘না’ । যে প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বলছিলাম সেটা হল, প্রায়ই ফেসবুকে কোনো ছেলের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার পরই প্রথম টেক্সট, আপনি কি বিবাহিত? তারপর বয়স কত? আপনার বন্ধু হতে পারি? তারপর কল। তার আর পর নেই। ভাই অনেক হলো, এবার ভাগ। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাগিয়ে দেয়াটা সুবিধে। বেশিরভাগ এফবি বন্ধুরাই অপরিচিত। আবার পরিচিত বন্ধুবান্ধব যারা হারিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে খুঁজেও পেয়েছি। আবার অনেক পরিচিত বন্ধুকে হারাতে বাধ্য হই। যখন তারাই বলে ওঠে, “কি রে অনেক পাল্টে গেছিস? একদিন চলে আয়। একটু সময় দে।” এইসব আর কি। কথাগুলো যে খুব খারাপ তাও নয় কিন্তু কোথায় একটা ইঙ্গিত থেকেই যায়, যে ইঙ্গিতটা বন্ধুত্বে খুব বেমানান। খুব খুব পরিচিত তারা। এদেরকে অপরিচিতের তালিকায় ফেলে দিতে হয়। এই কথাগুলোর মুখোমুখি আমাদের প্রায় সব মেয়েকেই হতে হয়। আপনার প্রেমের ডাকে সাড়া না দিলে আপনি অনেকদূর যেতে পারেন। না শব্দ কে মান্যতা দেবার দায় প্রেমিককে বইতে হয়না। তাহলে একবার ভেবে দেখুন তো, বাড়ির মেয়েটি তার বাবা, কাকা, দাদা, আত্মীয় পুরুষদের কাছেই বা কতখানি নিরাপদ? সংবাদপত্রে সেসব খবর প্রকাশিত হয় কি? হয় না। খুব লজ্জা লাগে।

আমরা মা বাবারা প্রায়ই বলে থাকি, মেয়ে আমার কথা শোনে, কিন্তু ছেলেটা না একদম কথা শুনতে চায় না। কথা শুনলে ছেলেটিকে ঠিকমতো ছেলে করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়না। আর মেয়েটিকে তো অন্যের বাড়িতে অভিযোজনের শিক্ষা জন্মের পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। ছেলেদের অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক নয়। বরং যে করে সে মহাপুরুষ। আর এই মহাপুরুষে না উন্নীত করার দায়টা আমরা অভিভাবকরা স্বীকার করিনা। তবে বিকৃত মানসিক রুগীদের কথা বাদ দিলাম। কারণ খলের তো আর ছলের অভাব হয়না। যখন ফেইসবুক ছিল না, তখন ও দেবর্ষি রায়চৌধুরীর ঘটনা, অক্সিটাউনের ঘটনা ঘটেছে। প্রেমে পড়ে মানুষ কী করতে পারে আর কী করতে পারে না! মুশকিল হচ্ছে প্রেম আশীর্বাদ না অভিশাপ হবে সেটা নির্ভর করছে ওই বিজ্ঞানের মতোই। আপনি কিভাবে প্রেমের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন, সেই ব্যবহারই বলে দেবে আপনি কতবড় প্রেমিক।

আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি, বাসে ট্রেনে কোনো ছেলের পাশে যদি কোনো মেয়ে বসে থাকে সে কিরকম যেন ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে। আবার প্রচুর মেয়ে ফেসবুকে অব্দি নিজের পরিচয় ছবি গোপন রেখে নারীবাদী বক্তব্য লিখে যায়। বোরখা বা ঘোমটা পড়ার চেয়ে এটাই বা কম কিসে? আমরা স্বনির্ভর হতে পেরেছি, কিন্তু দ্বিধা ও বিভেদের উপরে উঠতে পারছি কোথায়? এখন চিঠির যুগ নেই, মোবাইল, এফবি, হোয়াটসঅ্যাপ হয়েছে। এখানেই অনেকের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুবই ভালো, কিন্তু এই বন্ধুরা কিংবা সহপাঠীরাই যখন খুনী বা ধর্ষকের ভূমিকায় জেগে ওঠে, সেটাই এত কথার মাঝে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সময়ের সাথে সহজ স্বাভাবিক বয়ঃসন্ধির মিষ্টি প্রেমগুলো কেমন যেন অনিচ্ছাকৃত দৈহিক উত্তেজনায় ভরে ওঠে।

আমরা উন্মুক্ততার স্বাদ গ্রহণ করে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটে ভুলে যাই আমাদের উল্টোপিঠে থাকা মেয়েটির প্রতিকূলতা, সীমাবদ্ধতা ও তার নিরাপত্তা। যে কোনো প্রকার আনন্দ যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, এই জীবনশৈলী শিক্ষা আমাদের যৌনশিক্ষার বিষয় বহির্ভূত। তবে পশ্চিমের অনেক মানুষই কিন্তু ভোগবাদের আসক্তি ছেড়ে ত্যাগ ও যোগের দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে পূবের পথে পাড়ি দিচ্ছে। ত্যাগ ও ভোগের ভারসাম্য রক্ষায় সংযমের আদর্শ অনেক সময় কঠিন হলেও পারস্পরিক সুবিধার্থেই নিতে হয়। আমরা আনন্দের স্বাদ নিতে ভালোবাসি কিন্তু নিজেরা নিজেদের দায়ভার নিতে অপারগ, সে ছেলেই হোক বা মেয়ে ।

সংযম ও ত্যাগের শিক্ষার জন্মই বোধহয় এই কারণে হয়েছিল যাতে মানুষের অপরাধ প্রবণতা কিছুটা হলেও সুষ্ঠ পথে দমন করা যায়। যেকোনো প্রকার অনিচ্ছাকৃত সম্ভোগের জন্মই হয় অনিয়ন্ত্রিত বিদ্বেষ থেকে। বিদ্বেষ, ভালোবাসাও একই সাথে চলতে পারে এই সংযম ক্ষমতার জন্যেই। অতিরিক্ত ভোগ প্রবণতা ও সহজলভ্যতা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কি সেই আত্মহননের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে না? এই ভাবনাটা তখনই সমাজের কাছে প্রাধান্য পাবে যখন আমরা বড়রা ছোটদেরকে সুস্থ রুচির পথ দেখাব। দায়টা তাই আমাদেরও। সমাজ তো আমি থেকেই শুরু। শিক্ষার বাণিজ্য সম্পর্কের বাণিজ্যিকিকরণের পথ প্রদর্শক যাতে না ওঠে সেটাও ভাববার বিষয় কারণ তার প্রথম বিষফল কিন্তু অভিভাবককেই গ্রহণ করতে হবে। ভালোবাসার বিশ্বাস এই অবাঞ্ছিত সাময়িক আনন্দের মোহে রূপান্তরিত হবে। অসময়ে পেকে ওঠা ফলের পতনও তো অসময়েই হয়। ফলে মেয়েদের জীবন বদলানোর ছোটো ছোটো পদক্ষেপগুলি আমাদের কাছে তাদের ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণের দলিল হিসাবেই গৃহীত হবে, কোনো সমষ্টিবাচক সমাজ বদলের ইঙ্গিত দিতে পারবে না। আর পুরুষকে প্রেমিক হতে গেলে নারীর ‘না’কে মান্যতা দিতে হবে। প্রেমিক-প্রেমিকা হওয়া বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

One thought on “আত্মরক্ষা বনাম আত্মীয়তা

  • Nilkanta Chatterjee

    Khubi valo hoyeche lekhata

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *