শিশুকামিতা ও নীরব দর্শক
সাহারা ইসলাম ।। আমি প্রায়শই ফেসবুকে অনেককে দেখি Pedophile বা শিশুকামীদের নিয়ে ডার্ক মিমস, সার্কাজম করতে। তারা বিষয়টা ভীষণ হাল্কা ভাবে দেখে। কিন্তু যারা Pedophile বা শিশুকামীদের দ্বারা হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়েছে, তারা এ ধরনের হাস্যরসাত্মক পোস্টে ব্যথিত হয় এবং তাদের ওপর প্রভাব ফেলে।
আমি নিজেও হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়েছিলাম অনেক ছোট বয়সে। কিন্তু সেই ঘটনার কথা আমি কখনোই কাউকে বলতে পারি নি। কিন্তু ভুলেও যাই নি। এখনো হঠাৎ হঠাৎ আমার মনে পড়ে। এবং এও জানি এই স্মৃতি কখনোই আমার পেছন ছাড়বে না।
অনেক আগের ঘটনা, আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। আমার বড় ভাই ক্লাস টেনে পড়তো। সে একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতো। আমি ছোট থাকায় আমার মা আমাকে নিয়ে ভাইয়ার কোচিং সেন্টারে গিয়ে বসে থাকতো। ভাইয়ার ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতো।
তো সেই কোচিং সেন্টারের এক দারোয়ান আমাকে মলেস্ট করেছিল। ওই লোক অনেক বয়স্ক ছিল। বয়স ৬৫+ ছিল আন্দাজ করি। এখন সম্ভবত বেঁচেও নেই। উনি আমার মাকে ‘মা মা’ বলে সম্বোধন করতো। আমাকে কোলে নিতে চাইতো। আমার আম্মু আমাকে তার কোলে বসিয়ে অন্য অভিভাবকদের সাথে গল্প করতো।
প্রথম প্রথম আমি বুঝি নি। কারণ আমাকে কেউ গুড টাচ, ব্যাড টাচ সম্পর্কে কখনোই জানায় নি, শেখায় নি। স্কুলেও শেখানো হয় না। একদিন আমি বুঝতে পারলাম, উনি আমাকে কোলে বসিয়ে আমার ফ্রকের নিচে হাত দিচ্ছে। এরপর আমার প্যান্টের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বারবার আমার ভ্যাজাইনা স্পর্শ করছে। আমি তখন ফ্রক পরতাম। ক্লাস ওয়ানে পড়তাম, হয়তো মনে প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে এতো ছোটবেলার ঘটনা মনে রেখেছি। আমার বরাবরই স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর। অনেক ছোটবেলাকার সামান্য সামান্য কিছু ঘটনাও আমার এখনও আবছা মনে আছে। আর সেই তুলনায় এটা মনে থাকাটাই স্বাভাবিক।
আমি আমার সাথে হওয়া হ্যারেজমেন্টের কথা কাউকে বলতে পারি নি। গুড টাচ ব্যাড টাচ সম্পর্কে না জানলেও আমার মনে হতো যা হচ্ছে সেটা ভালো নয়। ভীষণ বিশ্রী নোংরা লাগতো। আমি অবশ্য একদিন আমার মাকে বলতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সত্যটা বলতে পারি নি। আমি মাকে বলেছিলাম ওই বয়স্ক লোকের কথা যে উনি আমার পেটে হাত দেয়। চিমটি কাটে। সুড়সুড়ি দেয়। মা বলেছিল, এসব কিছু না। দুষ্টামি করে তোমার সাথে।
এরপর আমার ভাই কোনো কারণে আর ওই কোচিংয়ে ক্লাস কন্টিনিউ করে নি। আর যাওয়া হয় নি। কিন্তু ওই বাজে স্মৃতি আমার সঙ্গে আজীবনের মতো জুড়ে গেলো। এখনও মাঝেমধ্যে যখন মনে পড়ে। তখনও আমার ভীষণ ঘেন্না লাগে। নিজের প্রতি না। ওই বিকৃত মানসিকতার লোকটার প্রতি।
শুধু এই ঘটনাই না। এরপর যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম, তখনও একজন আমাকে মলেস্ট করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারে নি। আমি তখন একাই স্কুলে কোচিংয়ে যাওয়া আসা করতাম। গুড টাচ, ব্যাড টাচ কী তা জানি ও বুঝি। সকালে কোচিংয়ে যাওয়ার পথে ওই কোচিংয়ের পাশের বিল্ডিংয়ের একজন কেয়ারটেকার হবে, তার বয়সও ৬৫’র বেশি হবে। আমাকে নানু নানু ডাকতো। আমি কীসে পড়ি, আমার গ্রাম কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করতো। বলতো গ্রামে আমার মতো বয়সের তার নাতনী আছে। তাই আমাকে দেখে নাতনীর কথা মনে হয়।
এটা শীতের সময়ের ঘটনা। আমি জামার ওপর কয়টা সোয়েটার পরেছি সেটা জিজ্ঞেস করে আমার পিঠে আর বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করছিল। আমার ভীষণ আনকম্ফোর্টেবল ফিল হচ্ছিল। আমি সাথে সাথে সরে যাই। তাকে বললাম এভাবে গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না একদম। উনি তখন এমন ভান করলো যে, আমি তার নাতি নাতনীর বয়সী। তাই উনি আদর করছে। কিন্তু আমি বুঝেছি এই স্পর্শ ভালো নয়। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। এরপর আমি তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি।
এরপর আবারও একদিন সে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কথা বলতে শুরু করে। আমি দূরত্ব রেখেই কথা শুনছিলাম। এরপর উনি আবারও আমার পিঠে হাত রাখার চেষ্টা করে। আমি তখনই হেঁটে চলে যাই। বাসায় জানাই। আমার মা গিয়ে ওনাকে শাসায়। এরপর আর কখনো ডিস্টার্ব করে নি।
এসব Pedophile বা শিশুকামীরা শুধু বাইরেই না, ঘরে নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও অসংখ্য আছে। কিন্তু তারা পার পেয়ে যায় বয়সের দোহাই দিয়ে। বাবা মায়েরা পর্যন্ত শিশুদের কথা বিশ্বাস না করে ওই নোংরা লোকদের বিশ্বাস করে। আর তাদের অবহেলায় অসচেতনতায় অসংখ্য শিশু প্রতিনিয়ত যৌন হেনস্থার শিকার হয়।
এছাড়াও কলেজে ওঠার পর লেগুনায় যখন যাওয়া আসা করতাম, তখন বয়স্ক আর মাঝবয়েসী লোকেরাই সবচেয়ে বেশি হ্যারেজ করেছে। পাশে বসে হাতের কনুই দিয়ে পিঠে বুকে পেটে টাচ করার চেষ্টা করেছে। আমি তাদের সরে বসতে বলতাম। কেউ কেউ সরে বসতো, আবার অনেকে বলতো এটা পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট। নিজের প্রাইভেট কার নয় যে ইচ্ছামতো বসে যাওয়া যাবে। কিন্তু আমি তখন চুপ করে যেতাম না। আমিও কড়া স্বরে জবাব দিতাম – “এটা যে পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট সেটা সবারই মাথায় রাখা উচিত। নিজের বাসার ড্রয়িং রুম নয় যে শরীর এলিয়ে বসবে।” আর এ ধরণের ঘটনায় কখনও লেগুনার অন্য যাত্রীরা টু শব্দও করে নি। এমনকি নারী যাত্রীরাও না। বরং কেউ কেউ এদের হয়েই সাফাই গাইতো।
পাব্লিক ট্রান্সপোর্টে চলাফেরা করা অধিকাংশ নারীকেই সম্ভবত জীবনে একবার হলেও শুনতে হয় যে এটা পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট। অর্থাৎ তোমরা নারীরা যদি গণপরিবহনে যাতায়াত করতেই চাও তাহলে বুকে পিঠে কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে, হ্যারেজমেন্ট-এর শিকার হয়েই যাতায়াত করতে হবে। কোনো রকম যৌন হেনস্থার শিকার না হয়ে চলতে পারবে না। গণপরিবহনে যাতায়াত করলে নারীদের হেনস্থা হতেই হবে – এ যেন স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর প্রতিবাদ করলেই শুনিয়ে দেয়া হবে এটা গণপরিবহন।
এটা যে গণপরিবহন সেটা মনে রাখার দায়িত্ব বুঝি শুধু নারীদেরই, পুরুষদের নয়! তারা যখন ইচ্ছে পাশে বসা নারীকে সোফা ভেবে গা এলিয়ে দিতে পারে। গায়ে হাত দিয়ে বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করতে পারে। বর্তমানে পাব্লিক প্লেসে এবং গণপরিবহনে যৌন হেনস্থার ঘটনা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আর এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ চুপচাপ মেনে নেওয়া, যা কিনা এদের মতো নিকৃষ্ট মানুষদের অন্যায় নোংরামিকে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। চুপ করে মেনে নিয়ে সহ্য করে কখনো কোনো কিচ্ছুর সমাধান হয় নি। হবেও না। বরং চুপ করে থেকে আমরা এই বিকৃত মানসিকতাকে বাড়িয়েছি, এদের দৌরাত্ম্যকে বাড়িয়েছি।
কিছুদিন আগে একটা ভিডিও অনেক ভাইরাল হয়েছিলো, একটি মেয়ে গণপরিবহনে হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়, এরপর মেয়েটি হ্যারেজ করা ব্যক্তিকে প্রচুর উত্তম মাধ্যম দিয়েছে। শুনেছি ওই বাসের প্রত্যেকে মেয়েটাকে বলেছে সে যেন ওই লোককে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটি তা করে নি।
আপনাকে থামাতে চাওয়া এই মানুষগুলো আপনার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও প্রতিবাদ করবে না। দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে, ভিডিও করবে কিন্তু আপনি প্রতিবাদ করলেই তারা আপনাকেই থামাতে চাইবে কারণ তারা নিজেরাও ওই হ্যারেজ করা ব্যক্তিদেরই একজন। এরা নিজেরাও হ্যারেজ করে এবং নিরব সমর্থন দেয়। নারীর প্রতি যেকোনো নির্যাতন সহিংসতায় এরা পৈশাচিক আনন্দ পায়।
তাই এদের কথায় থেমে গেলে চলবে না। নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে। নিজেরই নিজেকে সাহায্য করতে হবে। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করলেই এই নোংরা কিন্তু ভীতু আর নিকৃষ্ট মানুষদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]