December 23, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ২

মেরা সুলতানা

মাসকাওয়াথ আহসান ।। ইস্তানবুলে আজ রোদ ঝলমলে দিন। বেস্ট ওয়েস্টার্ন ইমপেরিয়াল প্যালেস হোটেলের জানালা দিয়ে সামনের মসজিদটি দেখছি। মসজিদ এখানে কম্যুনিটি সেন্টারের মতো। নারী পুরুষ সবাই আসেন। প্রার্থনা করে ফিরে যান। পুরুষের মাথায় টুপি নেই, নারীর পরনে বোরখা নেই।

এ যেন বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের দেশ। মসজিদের পাশে প্রতিটি শো রুম পরিচালনা করছেন নারী, ইতালিতে যেমনটা দেখেছি। হোটেল ম্যানেজার আমার স্ত্রীর সঙ্গে রসিকতা করে বলেছে, হাজব্যান্ডকে একা ছাড়বেন না মাদাম। এটা তুরস্ক, শিক্ষিত সাবলীল পুরুষ এখানে নারীদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের।

কথাটা শতভাগ সত্যি। ফুটপাথে সিগেরেট মুখে দাঁডালে কোত্থেকে একজন নারী এসে লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে সিগেরেটে, সোফিয়া লরেনের মতো স্নিগ্ধ সানফ্লাওয়ার ফুটে থাকে তাদের হাসিতে। নারী ক্ষমতায়িত এবং সৌম্যকান্তি। তুরস্কের নারী পুরুষের পবিত্র মন, কেউ কারো দিকে লোভ নিয়ে তাকায় না। পুরুষের দৃষ্টিতে এতো নিষ্পাপ অভিব্যক্তি আমি কোথাও দেখিনি। মেয়েরা যেমন বাবার গৃহে আদরে ও দাপটে থাকে, পুরো তুরস্কই সেই বাবার গৃহ যেন। রাত দুটোর সময় মেয়েরা হেঁটে যায় নিশ্চিন্তে। বরং পরদেশী কোন পুরুষেরই সামান্য সংকোচ হয়, যখন যে কোনো মেয়ে এসে অবলীলায় গল্প শুরু করে। তবে তা নেহাত নির্মল চায়ের নিমন্ত্রণ। ইস্তানবুলে কোনো লিটনের ফ্লাট নেই।

এখানে বেলি ডান্সার, সোহোর নর্তকী কিংবা ডিসকোতে গ্রীবা উঁচু করে নাচতে থাকা মোহন ঘোটকী, এতো সুন্দর মন এতো সুন্দর দৃষ্টি, বড্ড সুন্দর করে মানুষ করা হয় কন্যা শিশুদের।

অফিসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নারী যেন গড মাদার। গ্রীক মিথের বরেণ্য দেবী, ইসলামী সংস্কৃতির ক্ষমতায়িত বিবি খাদিজা কিংবা রুমীর বান্ধবী জর্জিয়ার রাজকুমারী, নারী এইসব নান্দনিক সংস্কৃতির অস্থিধারণ করে অনুপম অবয়ব পেয়েছে এই নারী রাজ্যে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বোধহয় কামাসূত্র আর উর্বশী রম্ভাকে অবজেক্ট হিসেবে উপস্থাপনের ভ্রান্তি থেকেই কি হিন্দু কি মুসলমান, নারীকে কেবলই যৌনতার অবজেক্ট হিসেবে দেখা হয়। দক্ষিণ এশীয় পুরুষ পারলে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থেকে নারীকে গর্ভবতী করে দেবার  আদিম আকাংক্ষায়। দক্ষিণ এশিয়ার পুরোহিতের সেবাদাসীর বিকৃত স্বপ্ন কিংবা মোল্লার হুরের যে বিকৃত স্বপ্ন, এইসব ফল্টলাইনগুলো নারীকে খাজুরাহ কিংবা তেঁতুলের অপমানজনক আত্মপরিচয় দিয়েছে।

তুরস্কের নারী পাইলটের টেক অফ কিংবা ল্যান্ডিংয়ের যে দক্ষতা, দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষ পাইলটের তা নেই। এখানে নারী পুলিশের যে ফিটনেস, তা আমাদের এলাকার ঘুষ খেয়ে পেট মোটা করা দলীয় তেলাঞ্জলী পুলিশের নেই।
আমার স্ত্রীর সঙ্গে তুরস্কের পুরুষদের কথা বলার সময়ের দৃষ্টি শিষ্টাচার গুরুত্বের সংগে বিবেচনা করা দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন পিতৃগৃহে এসেছে, সবাই তাকে ফ্যাসিলিটেট করছে।

আমাকে এতো মধুর স্বরে ব্রাদার বলে তুর্কীরা যেন আমি ঈশ্বরদী বাজারে আড্ডা দিচ্ছি। এ আমার কতদিনের চেনা জনপদ। এখানে মানুষের মাঝে সাদাসিধে জীবনের চর্চা এতো গভীরে যে, ১০০ টাকার নোট পর্যন্ত ঠিক আছে, ২০০ টাকার নোট বের করলেই সন্দেহের চোখে তাকায়। এক রেস্তোরার মালিক তো হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন, ব্রাদার কি গভমেন্ট পার্টির পলিটিশিয়ান! আমার মনে হচ্ছিল ধরণী দ্বিধা হও।

নিজের জন্য খরচ করার ক্ষেত্রে আমি কৃপণ। রুমীচর্চা করতে করতে এখন আর দামী পোশাক কিনতে ইচ্ছা হয় না। কিংবা আমি শিশুকাল থেকে শেখ সাদীর পোশাকের মাহাত্ম্য গল্পপাঠ করে ঠিক করেছি, কী দরকার এতো বিলাসিতা! আম্মাই জোর করে বাজারে নিয়ে গিয়ে দামী পোশাক কিনে দিতেন। আম্মার কাছ থেকে দূরে থাকি বলে স্ত্রী ঠিক সেটাই চেষ্টা করে।
একটা শো রুমে পোষাকের বিল বেশি আসায় সেলস গার্ল বিস্মিত। সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল। তুরস্কের তরুণেরা পলিটিশিয়ানদের করাপ্ট মনে করে। মেয়েটি পাসপোর্ট চাইলো ফেরার সময় এয়ারপোর্টে কিছু ট্যাক্স মানি রিটার্ন পাবো বলে। তরুণী সহকর্মী তরুণের কাছে ফিসফিস করে বলছিল, মনে হয় পলিটিশিয়ান।

আমি পরে ইচ্ছা করেই বললাম, আমি শপিং করার সময় কম পাই তাই একবারে কিনলাম। আমি মধ্যবিত্ত। তরুণী আমাকে ক্যান্ডি দিয়ে বললো, আসলে আমাদের দেশেরও একমাত্র প্রবলেম করাপ্ট পলিটিশিয়ান। এরদোয়ান এগুলো পোষে। আমি এই সরকার আর চাইনা।

আমি হেসে বললাম, এরদোয়ানের বিকল্প দেখাও!

মেয়েটি স্নিগ্ধ হেসে বললো, কেন আমাকে দেখছো না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *