ধর্মের কল আর বাতাসে নড়বে কি?
সাদিয়া মেহজাবিন ।। শৈশবে নানান ভাবনা নিয়ে আম্মার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘সৃষ্টিকর্তা কি চারকোণা, চারপাশে ফুটো করা বাক্সের মত?’ সারাদিন সংসারের ব্যস্ততায় আম্মা আমার কথা পাত্তা না দিয়েই নিজের মনের সুরে কাপড় সেলাই করে গেলেন। এরপর কত বছর আমার মনে এত প্রশ্নের সমাহার জন্মে, আমি এক বৃহদাকার অমানুষে পরিণত হয়েছিলাম। ঠিক পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, ইয়স্তেন গার্ডারের সোফির জগত। জি এইচ হাবীব স্যারের অনুবাদে শিক্ষক মন্টে ব্যারেটের উপহারের বইটি। সেখানে একটাই প্রশ্ন আজও আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কে তুমি?
অষ্টম শ্রেণিতে যখন বিজ্ঞান বিভাগ বাছাই করি তখন একদম নিজের ইচ্ছেতেই নিয়েছিলাম। আমার আফসোস হয় কখনো মজাদার বিজ্ঞান ক্লাস পাইনি। আমাদের তখন বিজ্ঞান ক্লাসে বেশিরভাগ মুখস্ত করানো হতো বৈজ্ঞানিক নাম, সাল নাহয় সংজ্ঞা। এসবে কেউ ত্যক্ত বিরক্ত হচ্ছে বলে আমার মনে হতো না কারণ সবাই হয়তো ভাবতো, এমনই তো হবার কথা। একদিন বাধ সাধে ইসলাম ধর্ম ক্লাসে। এক শিক্ষার্থী মানতেই নারাজ আমরা মাটি থেকে তৈরি। এরপর আমি জানতাম তার সাথে কী হতে পারে। স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষকই তাকে কুনজরে দেখতো। বিজ্ঞান শিক্ষক তো বকেই দিলেন। বললেন, তোমাকে কি আমি এসব শিখিয়েছি?
আমি তখন ইন্টারে, বেশ চিন্তায় ছিলাম আদৌ বিজ্ঞান বিভাগে থাকবো কিনা। তবুও নিয়েছিলাম বিজ্ঞান। জানি না, এত সুখ আগে পেয়েছিলাম কিনা। দেখা মেলে দুইজন শিক্ষকের- নাম দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য আর আবদুল্লাহ আল নোমান স্যারের। প্রথম দিন দেবাশীষ স্যার জিগ্যেস করেছিলেন, বিজ্ঞান কী? কুপমন্ডুক শব্দের সাথে পরিচিত কিনা। এরপর সিলেবাস আর বইয়ের নাম মুখে না নিয়েই তিন মাস পড়িয়ে ফেললেন বিজ্ঞানের ইতিহাস, ক্যালকুলাসের ইতিহাস এবং গ্যালিলিওসহ হাইপেশিয়ার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা। এরপর যদিও কিছু শিক্ষার্থীর চাপে বইয়ের দরজায় এসেছিলেন কিন্তু তাও ক্যালকুলাস শুরু করতেও দুই মাস লেগে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে এসে কেবল বিজ্ঞানকে ভালোবেসে বাংলাদেশে আর বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়নি। আজ এত কথা স্মৃতির পাতা থেকে কলমে আসার একটাই উদ্দেশ্য বিজ্ঞান শিক্ষকদের করুণ অবস্থার হাহাকার দেখে। ফেসবুকের পাতায় দেখা মেলে দুইজন বিজ্ঞান শিক্ষক তাদের জীবনের করুণ অবস্থার কথা জানাচ্ছেন। একজন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এবং অন্যজন জানের ভয়ে চুপ আছেন। তখনই পত্রিকায় ভেসে আসছে মুন্সিগঞ্জ সদর বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নিশ্চুপ চাহনি। দোষের পাতায় ধর্ষণ বা জালিয়াতি বা দুর্নীতি কিছুই নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? মূল সমস্যা ধর্ম অবমাননা! নবম দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর প্রশ্ন – ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে। প্রশ্নটা সুন্দর, সাবলীল, ঠিক আমার শৈশবের মতো। কিন্তু শিক্ষার্থী জানার চেয়েও বেশি, উস্কানিমূলক প্রশ্ন হিসেবে ছুড়ে দেয় এই তীর। ১৫ বা ১৬ বছরের একজন শিশু কেন শিক্ষককে ‘মালাউন’ বলবে?
ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ক এমন প্রশ্ন শুনে মনে পড়ে গেল বহু বছর আগে ফেসবুকে লেখা আমার এক প্রশ্নের কথা। ‘আচ্ছা মাদার তেরেসা বা নিউটন কি জাহান্নামে যাবে?’ বিশ্বাস করুন সাথে সাথেই আমাকে সবাই কমেন্টে জানিয়ে দেয় ঈমান নাই যার জান্নাত নাই তার! এবং আমাকে এক প্রকার হুমকির মুখে পড়ে ফেসবুক থেকে সে পোষ্ট সরিয়ে নিতে হয়। তখন যতটা অসহায় ছিলাম এখন ততটা আর নই। তাই বলতে দ্বিধা নেই – আপনারা কি সংযোগ খুঁজে পান না? কেন একজন শিশু তার শিক্ষককে মালাউন বলে গালি দিচ্ছে? কেন শিক্ষার্থীরা গণহারে সর্বত্র নামাজ ঘর চাচ্ছে?
ধর্ম আর বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় পার্থক্য, ধর্মে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না! কিন্তু বিজ্ঞানের যেকোনো তত্ত্বে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন ওঠে এবং খনন চলতেই থাকে।
একজন শিক্ষকের ধর্মীয় পরিচয় জেনে তাকে উস্কানিমূলক প্রশ্ন ছুড়ে মালাউন গালি দেওয়া বাংলাদেশেই সম্ভব। আমাদের দেশে ধর্মের বীজ খুব সুন্দর করে বপন করা হয়েছে। এর শাখা-প্রশাখা বাড়বে। যখন হিন্দুদের বাড়ি পোড়ানো হলে আপনি প্রতিবাদ করেন না তখনো এই দায় এসে বিজ্ঞান শিক্ষকের মাথায় পড়ে! এসব আমাদেরকে দিনে দিনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতে পরিণত করছে। ভাবুন!
অভিজিৎ হত্যার বিচার, বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার , হুমায়ুন আজাদ হত্যার বিচার এ দেশে হবে না। কেননা এই দেশই প্রধান হোতা। ধর্মকে প্রশ্ন করা যায় না, ঈশ্বরকে প্রশ্ন করা যায় না। দেশকেও আর প্রশ্ন করা যায় না।
ধর্মই একমাত্র বলে জিহাদ করো। ধর্মই বলে নারীকে বন্দী করো। ধর্মই বলে অন্য ধর্মকে জ্বালিয়ে মারো। তাই যতই ইতিহাসতত্ত্ব খাটান দেশে আর সম্প্রীতি আসবে না। এর কারণ নির্মূলের প্রয়োজনও হয়তো নেই। আমরা সকলেই জানি, ধর্মের কল আর বাতাসে নড়বার নয়। শিক্ষকই বরং জেলে যাওয়ার যোগ্য কেননা শিক্ষার্থীরা আর মানুষের উৎপত্তির কথা জানতে চায় না।
বিজ্ঞানের কথা উঠলেই দেবাশীষ স্যারের কথা আমার প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে। কিছুদিন আগেই ওনার এক ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ে বুক ফেটে কান্না আসে। ওনার অনুমতি নিয়েই লেখাটি দিচ্ছি।
‘‘গতকাল এক ছাত্রকে নতুন করে পড়ানো শুরু করেছি। সে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পা রেখেছে। ত্রিকোণমিতি দিয়ে শুরু করলাম, যেহেতু গণিতের অন্যান্য অনেক অধ্যায় এবং পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে ত্রিকোণমিতির প্রচুর প্রয়োগ তার করতে হবে। ত্রিকোণমিতি কী? এর উদ্দেশ্য এসব দিয়েই শুরু করলাম। মনে হলো সে আগ্রহ নিয়ে শুনছে। একসময় সে বলে উঠলো, স্যার এভাবে পড়ালে কি সিলেবাস শেষ করতে পারব? আমি বললাম, তুমি যখন গণিতের কোনো একটা বিষয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে, তখন তার গুরুত্ব অনুধাবন করা তোমার পক্ষে সহজ হবে। এবং এটা তোমাকে সে বিষয়ের তত্ত্বগুলোর প্রমাণ জানতে আগ্রহী করতে পারে যা গাণিতিক সমাধানে তোমার দক্ষতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেবে। তবে এতে তোমার সময় লাগবে এবং পরে নিজেই সমাধান করতে পারবে। আমার কাছে আর আসতে হবে না। আমি আমার ছাত্রদের সিলেবাস কখনো শেষ করে দেয়নি। তারা নিজেরাই সে যোগ্যতা অর্জন করেছে শেষ করবার।”
এরপর অনেকদিন মুঠোফোনে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। হয়তো সে আর আসবে না। এ মাসের শুরুতে একটা ব্যাচ শুরু করি। এতে পদার্থবিজ্ঞান কী আলোচনা করতে গিয়ে বলি, আজ থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগে প্রাইমেট গোষ্ঠীর একদল প্রাণী ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে মানুষ হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আমাকে প্রশ্ন করে, স্যার আমাদের ধর্মে আছে আদম-হাওয়া থেকে মানব জাতির সৃষ্টি। তা তো ভুল হতে পারে না। আমিও বললাম, হিন্দু ধর্মে আছে মনু-শতরূপা থেকে সৃষ্টি। তাহলে কোনটা সত্য? আজকের বিজ্ঞান তত্ত্ব ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মানুষের বিবর্তনের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা বিভিন্ন দেশের মানুষের বিকাশের সাথে মিলে যায়। এরপর সে শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত। এভাবে ধীরে ধীরে অনুপস্থিত হতে হতে আর দুজন আছে, এরাও হয়তো… এভাবে চলতে থাকলে এই পেশা চলাতে পারব না কিন্তু তারপরেও নিজেকে পরিবর্তন করে এখনো পেশাদারী মনোভাবটা আনতে পারলাম না।’
সিলেবাস শেষ করার তাড়া, না-জানার তাড়া আর ভুল শেখার তাড়া সব কিছুতে একজন শিক্ষার্থীকে দায় কেউ না দিলেও অবশ্যই একটা দায়িত্ব আছে। ইতিহাসত্ত্ব অথবা রাজনীতির এত প্যাঁচেও তারা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না কিন্তু দিনশেষে দায় থেকে যায় সেই বিজ্ঞান শিক্ষকের যে আফসোস করে, দায় থেকে যায় সে মা-বাবা’র যাদের শেখার চেয়েও একজন গাধা বেশি দরকার, দায় থেকে যায় সে রাজনীতিবিদদের যারা ধর্মের ব্যবসায় ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের।
যদিও এই দেশে হাহাকার করে লাভ নেই, লাভ নেই কিছুতেই। বাংলাদেশে আর ধর্মের কল বাতাসে কেউ নাড়াতে পারবে না। একদম গেঁড়ে বসেছে। তবে ছোট যে শিশুরা মালাউন বলে গালি দিচ্ছে তারা যদি সামান্য দায়িত্ব থেকেও নড়েচড়ে ওঠে তাহলে কিছুটা হয়তো সম্ভাবনার আশা রয়ে যায়।
বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের দ্রুত মুক্তি চাই। হৃদয় মণ্ডলকে আটক করতে যারা এই শিশুদের কাজে লাগাচ্ছেন তাদের বিচার চাই। হৃদয় মণ্ডলের মুক্তি হোক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]