সাইবার বুলবুলি
মাসকাওয়াথ আহসান ।। ড. ভীমরুল ইসলাম পশ্চিমা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। কিন্তু মাথার মধ্যে করে ভুরুঙ্গামারি গ্রামটিকে সঙ্গে এনেছেন; ফলে পশ্চিম তার মধ্যে কোন হেলদোল তোলেনা। ভুরুঙ্গামারি পাইলট স্কুল থেকে স্টার মার্কস পেয়ে এসএসসি পাশ করলে, সাত গ্রামের লোক দেখতে এসেছিলো তাকে। ভীমরুলের মা আনন্দের আতিশয্যে বলেছিলেন, আমার ভীম যে এতো ভালো ছাত্র; ও কি বাঁচবে; এতো ভালো জিনিস কি বাঁচে!
স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক বুঝিয়ে বলেন, এ দেশে অসংখ্য ছেলে স্টার মার্কস পায়; তারা যদি বাঁচে ভীমরুলও বাঁচবে।
চেয়ারম্যান সাহেব দশ কেজি মিষ্টি নিয়ে ভীমরুলকে অভিনন্দন জানাতে এসে, নিজের বড় মেয়ে সিনথিয়ার সঙ্গে ভীমরুলের বিয়ের প্রস্তাব দেন। সিনথিয়া ক্লাস সিক্সে পড়ে; তাকে জানিয়ে দেয়া হয়, তার জন্য ভীমকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে; সে যেন বিকেলবেলা হাঁটতে গিয়ে পল্লীকবি শামীম রেজার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে। চেয়ারম্যান সাহেব বোঝান, আগে ভালো ছাত্ররা কবিতা লিখতো। এখন এইটা খারাপ ছাত্রের কাজ।
কালক্রমে ভীমরুল বুয়েটের শিক্ষক হয়ে পড়ে; শামীমও বাংলা সাহিত্যের জাহাজ হয়ে বিরাট মাগণ ঠাকুর হয়ে পড়ে। সিনথিয়াকে ভুলে সে ক্যাম্পাসে ভ্যানগার্ড বিক্রেতা বাম বালিকা সখিনা কুহেলিকাকে বিয়ে করে। সখিনা যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে শোনায়, শামীমের মনে হয়, এইতো আমরা বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রগতিশীল দম্পতি হয়ে পড়লাম। টিভির সুপ্রভাত শোতে গিয়ে আমরা তুলে ধরবো কীভাবে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ম্যানেজার হয়ে পড়লাম। শামীম চোখ বুঁজে আলী যাকের ও সারা যাকেরের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করে। বাচ্চার জন্ম হলে, আজান দেবার পারিবারিক প্রথা রদ করে; নিজেই রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে ওঠে।
ভীমরুল শামীমের মিনি তারকা হয়ে ওঠাতে বিরক্ত হয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। সিনথিয়া টিভির মর্ণিং শোতে শামীম-সখিনাকে দেখে, ভীমরুলকে কথা শোনায়, কী হলো স্টার পেয়ে; টেনেটুনে পাশ করা শামীমই তো স্টার হলো।
এই কথা শোনার পর ভীমরুল রেগে বলে, ফেসবুকের পাসওয়ার্ড দেও; শামীমের লগে ইটিশ পিটিশ বুঝাইতেছি তোমারে!
শামীম কিন্তু মাঝরাতে সস্তা খুশিজল খেয়ে ঠিকই সিনথিয়ার ইনবক্সে এসে, ও চারু ও চারু, এনে দাও প্রেমের দারু; সখিনা ফেমিনিস্ট হইয়া গেছে গা; এখন তুমি ছাড়া আর কেউ নাই; কবিতার মিউজ হওয়ার জন্য।
সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে, মিউজ আবার কী! খুব ইংরেজি শিখছাও দেকতাছি!
পশ্চিমে চলে যাবার পর ভীমরুল ফেসবুকের পাসওয়ার্ডের ব্যাপারে আরো জটিল হয়ে ওঠে। সিনথিয়াকে জোর করে স্বামী-স্ত্রীর প্রগলভ প্রোপিক আপলোড করায়। সিনথিয়া ধীরে ধীরে শাবানার মতো কান্না রানি হয়ে পড়ে। যে মেয়ে ওড়না উড়িয়ে গ্রামময় ঘুরতো; সে এখন পর্দা করে; সহি হয়ে ঘুরে।
সে-ই একদিন ভীমরুলকে খবর দেয়, ফেসবুকে মেয়েদের সিক্রেট গ্রুপে কী সব দুষ্টু আলাপ হয়।
দুষ্টু আলাপের কথা শুনে ভীমরুলের মনের মধ্যে আনচান করে; কলেজ-ইউনিতে লেডিস কমনরুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় যেমন একটা শিহরণ হতো।
সিনথিয়ার পাসওয়ার্ড দিয়ে লেডিস সিক্রেট গ্রুপে ঢুকে দেখে, প্রগতিশীল দিদি বলছেন, স্বামীর কারণে যদি গতি ব্যাহত হয়; তবে ডিভোর্স দিয়ে প্রগতি হয়ে যাও।
সেইখানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো সেজে বয়েসী লোকের মনে দোল দেয়া আধুনিক তরুণী বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ স্ক্রিনশট ফাঁস করে; কইয়া দিমু কাম্পো হয়ে যাবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। সে বলে, পুরুষ মানুষ হচ্ছে বাটপার; আর ফেসবুক ভর্তি তাদের অ্যাপোলজিস্ট। দেশি পুরুষ খারাপ, গোরা পুরুষ ভালো। তারা আমারে “সোনাব্যাং” বলে ডাকে। গর্বে আরক্ত হয় কইয়া দিমু কাম্পো!
ভীমরুলের মাথা খারাপ হয়ে যায়, এদের সঙ্গে মিশলে সিনথিয়া বিগড়ে যেতে পারে! সে যদি কালা ভীমরুল রেখে ধলা সাহেবের প্রেমে মজে; তাহলে ভীমরুলের কী হবে! কত কষ্টে স্টার মার্কস পেয়ে যোগাড় করেছে এই প্রিন্সেস অফ ভুরুঙ্গামারি। সেইটা হাতছাড়া হলে সারাজীবন কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হবে।
ভীমরুল কইয়া দিমু কাম্পো আপার স্ক্রিনশট ফাঁস বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে সিক্রেট লেডিজ গ্রুপের স্ক্রিনশট ফাঁস করে লেখে, দ্যাখেন ভাই কীভাবে আমাদের সমাজের মেয়েদের নষ্ট করছে প্রগতি আপারা। এরপর আমাদের পুরুষদের গতি কী হবে কেউ একবার ভেবেছেন!
হাসনাথেন্দ্র ঠাকুর বিস্মিত হয় লেডিস ক্লাবে ঢুকে স্ক্রিনশট ফাঁস করার ভীমরুল মানসিকতা দেখে। সে তো এটা ভাবতেই পারে না। ছোট বেলায় মা-খালার আলোচনা থেকে বহিষ্কৃত হয়েও আগ্রহ জাগেনি; তাদের আলাপে কান পাততে। কলেজ-ইউনিতে গার্লস টক দেখলেই কেটে পড়া স্বাভাবিক মনে করেছে সে। এমনকি রাত আটটার সময় প্রগতি আপার, এই জীবনে কী পাইলাম কী পাইলাম না; সব দোষ পুরুষতন্ত্রের টাইপ পোস্টে সে ঘুরেও তাকায় না। একজন মহিলা মনের দুঃখের কথা বলছেন বলুন। শাবানা যেমন সেলাই মেশিন ঘুরাতে ঘুরাতে দুঃখের গান গাইতেন।
ভীমরুলের এই অশালীন আচরণের সমালোচনা করতে গিয়ে পশ্চিমে অবস্থানকারী সাহা দাদা ভীমরুলের ইউনিভার্সিটির ডিনের কাছে ইমেইল করে জানিয়ে দেয়, ভীমরুল একজন জিহাদি; তাকে পশ্চিমে রাখা ঠিক নয়কো। ইমেইলের উত্তর না পেলেও সাহা দাদা ফেসবুকে লেখেন, ভীমরুল আমার মতো পার্মানেন্ট ফ্যাকাল্টি নয়কো; সে অ্যাডজাংকট ফ্যাকাল্টি; সে বিদেশে এসে আমার মতো সফল ও সেকুলার হতে পারেনি।
সাহাদাদা তার বাবার তেল কলে ঘান ভাঙ্গানোর ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ পড়তো। তাই তো আজ সে সবাইকে অসাম্প্রদায়িকতার পৈতে পরিয়ে দেবার অথোরিটি পেয়েছে।
এবার কইয়া দিমু কাম্পো, ভীমরুলের প্রাইভেসি ভেঙ্গে স্ক্রিনশট প্রকাশের তীব্র সমালোচনা করে; ফেসবুকে সভ্যতার ও সিভিক সেন্সের চারুপাঠ দেয়। হিরো হীরালাল থেকে হিরোইন জেসিকা রাবেয়া; সবাই কইয়া দিমু কাম্পো তেলাঞ্জলি দিয়ে বলে, মনে হইতাছে আপনে রেনেসাঁ করতেছেন আপা।
ভীমরুলও কম নয়; সে তার শ্যালককে দিয়ে একটা পোস্টার বানায়, সেইখানে সে তার স্ক্রিনশট ফাঁসের সমালোচনাকারীদের সে “সাইবার বুলি”-র তকমা দেয়।
বুলি শব্দটি শুনতেই কাজী নজরুল ইসলামের বুলবুলি গানের কথা মনে পড়ে হাসনাথেন্দ্র ঠাকুরের –
“বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল।
আজো তা’র ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি,
তন্দ্রাতে বিলোল।
বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল।
আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায় ঝুরছে নিশিদিন,
আসেনি, যখন’ হাওয়া গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল।”
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত স্যাটায়ার লেখকের নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশ]