November 21, 2024
কলামফিচার ৩

“এখন থাক এসব কথা”

আঞ্জুমান রোজী ।। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক টিভি চ্যানেলে এক সফল নারীর সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তাকে অনুষ্ঠানে আনা হয়েছিল তার সফলতার কাহিনী ও রহস্য জানার জন্য। প্রশ্নও সেভাবে করা হচ্ছিল। নারীটি তার সাফল্য ও অর্জনের পেছনে কোন মোটিভেশনাল বিষয় কাজ করেছিল তার বিশদ ব্যাখ্যা এবং কারণ বুঝাতে গিয়ে জীবনের বৃত্তান্ত তুলে আনছিলেন। তাতে যৌক্তিভাবে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের অনেক ঘটনা উঠে আসে। বলাইবাহুল্য সবকিছুই ছিল তার জীবনের ঘটনার পরম্পরা। যার ফলশ্রুতিতে সব প্রতিকূল অবস্থা থেকে বের হয়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে  আজকে নারীটি সম্মানের সাথে সাফল্যের জায়গায় দাঁড়াতে পেরেছে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী আঘাতে আঘাতে ঘুরে দাঁড়ায়। জন্ম থেকে  নারী সেভাবে কোনো শিক্ষা পায় না যে, সে তার নিজের জীবন নিজের হাতে তৈরি করতে পারে। তারা পরনির্ভরশীল হয়ে বড় হয়। কিন্তু বড় হতে হতে যখন বুঝতে পারে তাকে কিছু মানুষ ব্যবহার করছে তাদের নিজেদের স্বার্থে, করছে অপমানে-অপবাদে অমানবিকভাবে পর্যুদস্ত, যেখানে মানুষের কোনো মর্যাদাই নেই; তখন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারী রুখে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ করে, এক সময় বের হয়ে আসে সেই জঞ্জাল থেকে। এমন রূঢ় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে নারীটি নতুন করে বাঁচার তাগিদ অনুভব করে, খুঁজে নেয় নতুন কোনো পথ।

সাক্ষাৎকার দেয়া নারীটি তার জীবনের এমনই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা বলছিল। কিভাবে তাকে ছোটকালে বিয়ে দেয়া হলো। বলতে গেলে তার বোধবুদ্ধি হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। যে বিয়েতে তার একদমই মত ছিল না। জোরপূর্বক এই বিয়ে পরবর্তীতে অনেক ঘটনায় জটিলতা সৃষ্টি করে। নারীটি আরো লেখাপড়া করতে চেয়েছিল। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজনসহ স্বামীটি তাকে পড়ার জন্য অনুমতি দেয়নি। নারীটির শিল্পের প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি আঁকা, গুনগুন করে গান গাওয়া, কোনো উড়ন্ত ফড়িং দেখামাত্রই অবচেতন মনে হারিয়ে যাওয়া, এ সবই নারীটির জন্য কাল হয়ে গেল। সংসার সে যতই মন দিয়ে যত্ন করে করুক না কেন, এমনকি স্বামীর সবকিছু ঠিকঠাক করে দেয়ার পরও মাঝেমাঝে তার উদাসীনতার জন্য চরম নির্যাতনের শিকার হতে হতো। নারীটির বাবার বাড়ি থেকে কেউ আশ্রয় দেয়া তো দূরে থাক তাকে সান্তনাটুকুও দিতে চাইতো না। সেইসাথে উঠে আসছিল স্বামীর অকথ্য নির্যাতনের কথা।  দিনের পর দিন কতভাবে নির্যাতন করেছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বলার চেষ্টা করছিল।

এমন সময় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী পুরুষটি তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে বলে, “এসব কথা থাক। এখন আমরা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি।” নারীটি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এখন কথা হচ্ছে, কেন নারীটিকে থামানো হলো? আমি যখন দেখছিলাম তখন খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। কোন পরিস্থিতিতে নারীটির মধ্যে পরিবর্তন এলো, কিভাবে সে বাঁচার চিন্তা করতে শুরু করলো, অর্থাৎ কোন চেতনা থেকে নারীটির ভেতর নিজ সত্তা জেগে উঠলো, তা অনেক নারীর বোঝার দরকার আছে। কারণ, এই মোটিভেশনাল সন্ধিক্ষণটা অনেক নারীর জন্য শিক্ষণীয় বটে। নারীরা তো ভুক্তভোগী হওয়াটাকে মনে করে এটাই তাদের স্বাভাবিক জীবন।  কিভাবে জেগে উঠতে হয় তার কোনো ধারণা অনেক নারীর মধ্যে নেই। সেক্ষেত্রে সফল নারীর এমন  নির্মম জীবনকাহিনী অনেক গুরুত্ব রাখে।

যাই হোক, নারীটিকে তার কষ্টের কথাগুলো বলতে না দেয়ার কারণ হলো, এক পুরুষ অন্য আরেক পুরুষ সম্পর্কে নারীদের কাছ থেকে নেতিবাচক বা খারাপ অর্থে কোনো কিছুই শুনতে চায় না। হয়তো এতে তাদের আত্মসম্মানে লাগে। স্বামী স্ত্রী বা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে লক্ষ্য করে দেখবেন পুরুষেরা পুরুষের পাশে থাকে, স্বামী বা বয়ফ্রেন্ড যত বড় অত্যাচারীই হোক না কেন! শুধু এক পুরুষ আরেক পুরুষের পাশেই থাকে না, বরঞ্চ নারীদেরকে বাধ্য করে এসব অত্যাচার নির্যাতন মেনে নিতে এবং এই মেনে নেয়াতেই পুরুষের কাছে নারীর  গ্রহণযোগ্যতা রক্ষা পায়। একেই বলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। এমন মানসিকতা পোষণের মধ্যদিয়ে পুরুষের এক ধরণের সুখবোধও আছে।

সবসময় লক্ষ্য করে এসেছি, স্ত্রী তার স্বামী সম্পর্কে কখনই খারাপ কথা বলতে পারে না। স্বামী সম্পর্কে ভালো কথা বলতে হবে। স্বামী যদি অত্যাচারী, অমানবিক হয় তাহলেও কিচ্ছু বলা যাবে না। এমনই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিধিব্যবস্থা করে রেখেছে যে, স্বামী মানেই হলো খোদা বা দেবতা। স্বামীদের কোনো দোষ নেই। তাদের সব দোষ হলো সহীহ্। এই মানসিকতা নারীর ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা মানতে বাধ্য করা হয়। অনেক নারীর জীবনের অভিজ্ঞতা এভাবেই জানান দিয়ে আসছে।

স্বামী সম্পর্কে বদনাম করলে স্বাভাবিকভাবে সেই বদনামের কিছু অংশ স্ত্রীর উপরও বর্তায়। স্বামীর সম্মানহানি মানে স্ত্রীরও সম্মানহানি, এমনটা ভেবে অনেক স্ত্রী চুপচাপ থেকে সব অত্যাচার সহ্য করে। কিন্তু সবকিছুর তো সীমা আছে! সহ্যের বাইরে যখন চলে যায়, তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক স্ত্রী মুখ খোলেন, প্রতিবাদ করেন। তখনই বিবাদটা বেঁধে যায় চূড়ান্তভাবে। এরজন্য দোষটা দেয়া হয় স্ত্রীকে। প্রথম কথাই হলো, “কত্ত খারাপ বউ! নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে কথা বলে!” অর্থাৎ স্বামী খারাপ একথা বললে স্ত্রীকেই খারাপ বলা হবে। এই ভয়টাও অনেক স্ত্রীর মধ্যে কাজ করে বলে সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে চলে।

তাছাড়া স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো স্ত্রী কথা বলতে গেলে তা কেউ শুনতেই চায় না। পুরুষের কাছে বললে তো, সোজা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্বামী লোকটার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বোঝাবে যে কিছুই হয়নি। অথবা নারীদের সমস্যায় কখনই কর্ণপাত করবে না। বিষয়টা এমন যে নারীদের কোনো সমস্যাই থাকতে পারে না। যদি কোনো সমস্যায় পড়ে, সেটা নারী তার নিজের কারণেই পড়ে, এমনই মানসিকতা পুরুষের। এসব ক্ষেত্রে সব পুরুষ এক। নারী সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে পুরুষরা সব একাট্টা হয়ে থাকে। স্ত্রী যদি একরোখা জেদি হয়, তাহলে আরো অন্যান্য পুরুষ দিয়ে সেই নারীটিকে হেনস্থা করে স্বামী পুরুষটির কাছে যেতে বাধ্য করবে। পুরুষ তো বিয়েই করে তার সেবাদাসী পাওয়ার জন্য। এই বিষয়টা যেন বহাল তবিয়তে থাকে তার জন্য সব পুরুষ শত অন্যায় করলেও পুরুষের পক্ষেই থাকে। কারণ, এদের প্রায় প্রত্যেকের চাহিদা একই।

আবার নারীদের কাছে কোনো স্ত্রী স্বামী সম্পর্কে বলতে গেলে তারাও খুব একটা শুনতে চায় না। তারা জানে পুরুষের বিরুদ্ধে গিয়ে লাভ নেই। বরঞ্চ ক্ষতিই হবে। যার প্রেক্ষিতে দেখা যায় সে সমস্ত নারী নিজেদের স্বামীর কাছে ভালো থাকার জন্য এবং সংসার ঠিক রাখার জন্য ভুক্তভোগী স্ত্রীটিকে পাত্তা দেয় না। তাহলে কী দাঁড়ালো! নারী বাধ্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে। যার ফলে পরনারীতে আসক্ত কিংবা কোনো নারীর সঙ্গে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখার পরও স্ত্রীকে সংসার করতে হয়। এই অবস্থা থেকে কোনো নারী বের হয়ে এসে মাথা উঁচু করে চললে পুরুষদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। সেই নারীটি সম্পর্কে যত রকমের কুৎসা আছে তা রটিয়ে দিয়ে নারীর বেঁচে থাকাটা হারাম করে দেয়। বাস্তবতা কিন্তু এমনই। তাহলে বলুন, সাক্ষাৎকারটি যে পুরুষ নিচ্ছিলেন, সে কেন এক সংগ্রামী নারীর কাহিনী তুলে ধরবেন? শুনতে ভালো লাগছিলো না বলেই তো মাঝপথে থামিয়ে দিলেন।

আমার মতে, প্রত্যেক ভুক্তভোগী নারী তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলুক। পৃথিবী জানুক কত বড় বড় অন্যায় হয় চার দেয়ালের মাঝে। যতদিন পর্যন্ত নারীরা মুখ খুলবে না, ততদিন পর্যন্ত নারীর মুক্তিও আসবে না। পুরুষ পুরুষের মতই আছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যেভাবে পুরুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে গেছে তাতে পুরুষেরা কখনই নারীর কথা শুনবে না, সেই সাথে নারীর সমস্যাও বুঝতে চেষ্টা করবে না। যদি চেষ্টাই করতো অর্থাৎ যে সমস্ত পুরুষ নিজেদের মানুষ মনে করে তারাও যদি নারীর সমস্যা অনুধাবন করার চেষ্টা করতো তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। যেহেতু যুগ যুগ ধরে তা হয়নি সেহেতু নারীকেই তার নিজের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। সোচ্চার হচ্ছে বলে নারী আজ জাগতে পারছে। যতই বাধা আসুক না কেন নারীকেই তার নিজের কথা বলতে হবে। যত বেশি বলা হবে ততই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মুখোশ খসে পড়বে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *