November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

অংকন বিশ্বাসের জন্য ন্যায়বিচার এনে দেবো আমরা

জেবা সাজিদা মৌ ।। পরিচয় – অংকন বিশ্বাস। ব্যাচের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষার্থী। একজন আইকনিক শিক্ষার্থীর সকল গুণই ছিল তার। নিজ ব্যাচে সে ছিল ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ডিবেটিং সোসাইটিতে ছিল অসাধারণ বিতার্কিক। টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করেছে একাধিক বার। তার হাত ধরে ইংরেজি বিভাগে এসেছে বেশ কিছু ট্রফি। নৃত্য, গান, আবৃত্তিসহ অন্যান্য বিষয়েও অংকন ছিল অতুলনীয়। এছাড়া মানুষ হিসেবে অংকন একজন ব্যক্তিত্ববান পরোপকারী মেয়ে ছিল। ডিপার্টমেন্টে তার পরিচিত কেউ বলতে পারবে না অংকনের থেকে কখনো তারা কোনো সাহায্য চেয়ে পায়নি।

এরকম একটি অসাধারণ মেয়ের ভয়াবহ অ্যাবিউসিভ (অংকনের চ্যাটের বিভিন্ন স্ক্রিনশট এবং ভয়েস ম্যাসেজ অনুসারে) একটি প্রেমিক/স্বামী ছিল, শাকিল আহমেদ, যে ভালোবাসার নামে অংকনকে দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার এবং ব্ল্যাকমেইল করে গিয়েছে। ডিবেটিং সোসাইটিতে তাদের পরিচয় এবং প্রণয়। অংকনের সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি পাসওয়ার্ড নিজের কুক্ষিগত করে রাখা, ফ্যামিলিকে জানিয়ে দেবার ভয় দেখানো, বন্ধু বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া, অংকনের নাচ বন্ধ করা, আইএলটিএসের ক্লাস বন্ধ করে দেয়া, নেটফ্লিক্স দেখা বন্ধ করে দেয়া, বারবার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ম্যানিপুলেট করে নিজের হাতের মুঠোয় জিম্মি করে রাখা, এগুলো ছিল ৫ বছর ধরে বেকার শাকিলের নিত্যদিনকার রুটিন। এবং এই শাকিল প্রায়ই অংকনের গায়ে হাত তুলতো, অংকন একা একা শাকিলের সাথে দেখা করতে যেতে পর্যন্ত ভয় পেতো, বলত, “শাকিল রেগে গেলেই গায়ে হিট করে।” আমরা আরো জানতে পারি যে অংকনের ভালো রেজাল্ট, ডিবেটিং ক্লাবে বারংবার ট্রফি জেতা, বিভিন্ন একাডেমিক কর্মকাণ্ডে অসামান্য অ্যাচিভমেন্টে শাকিল ইনসিকিউরড এবং জেলাস বোধ করত, এমনও দেখা গিয়েছে অংকনকে ক্লাস করতে বাধা দিত, পরীক্ষার আগের রাতে অংকনকে পড়তে বাধা দিত। জানা যায়, অংকনকে ব্ল্যাকমেইল করে শাকিল বিয়েও করেছিল।

শেষ পর্যন্ত ২৩ তারিখ রাতে অংকন তার বন্ধুদের জানিয়ে যায়, হুবহু অংকনের দেয়া টেক্সটটি তুলে ধরছি, “কালকে “মনস্টার”টার সাথে দেখা করতে হবে, সো আমাকে ফোন বা কিছু দিস না। বাসায় এসে আমি দিব। আর দিনের বেলা যদি আমি দেইও, ধরে নিবি শাকিল সামনে। সো ওকে নিয়ে কিছু বলবি না। এত লেইমগিরিও আমাকে করতে হইতেসে। কি বিপদে পড়লাম রে ভাই।”

সেই ভীতসন্ত্রস্ত অংকন ২৪ তারিখ মধ্য দুপুরের দিকে শাকিলের বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। শাকিল সেন্সলেস অংকনকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালে আসার পর অংকনের একে একে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, ব্রেইন স্ট্রোক হয়, আস্তে আস্তে প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ওর ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা পাগলের মত ফান্ড কালেক্ট করি অংকনের চিকিৎসার অর্থায়ন করতে। আর এই পুরোটা সময় শাকিল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যাই হোক, আমাদের এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অংকনকে বাঁচানো যায়নি, ৮ মে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে, ভাসিয়ে, উন্মাদ বানিয়ে অংকন চিরবিদায় নেয়।

অংকনের মৃত্যুতে আমরা যেখানে দিশেহারা, স্তব্ধ এবং অনেক কিছু জেনেও কিছু করতে না পারার ব্যর্থতায় ক্রুদ্ধ, তখন অংকনের প্রেমিক নিজেকে দায় ও সন্দেহমুক্ত করতে ২০ পেইজের একটি লেখা ফেইসবুকে পোস্ট করে। সেই পোস্টের ভাষ্যমতে, অংকন শাকিলের সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছিল, তাই সে অংকনের প্রতি পজেসিভ হয়ে কিছু ব্যাপারে ঝগড়া করেছে, এছাড়াও হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের সামাজিক ও পারিবারিক জটিলতার কথা ভেবে ডিপ্রেশনে গিয়ে অংকন সুইসাইড করেছে। তার ভাষ্যমতে অংকন কিছু একটা খেয়ে তার বাসায় আসে এবং এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অংকনের মতো একটা স্পিরিটেড এবং সদা প্রাণচঞ্চল মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে একটি সাধারণ সুইসাইড কেইস বানানোর জন্য স্পষ্ট ম্যানিপুলেশন ছিল তার স্ট্যাটাসের মূল বক্তব্যে।

তার স্ট্যাটাসে অংকন সম্পর্কে কিছু মিথ্যাচার আমরা দেখতে পাই, যেমন অংকন তার বন্ধুদের সাথে তাদের বান্ধবীর বিয়েতে যায়, যা শাকিল তার স্ট্যাটাসে উল্লেখ করে, ‘বন্ধুদের সাথে থার্টি ফার্স্ট নাইট কাটানো’ বলে। এছাড়াও সে ল’ ডিপার্টমেন্টের হয়েও ইংরেজি বিভাগের ফার্স্ট গার্লকে নাকি লিটারাচার বুঝিয়ে দিত, বিতর্কের নোট করে দিত! তার পুরো স্ট্যাটাসে কোথাও অংকনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা লেখা নেই, নেই রহস্য উদঘাটনের আগ্রহ। তার একটাই আকুতি, একটা জীবন চলে গেছে, তার জীবনটাও যাতে নষ্ট করা না হয়। পুরো স্ট্যাটাসে অংকনের সম্পর্কে তেমন পজিটিভ কিছু লেখা নেই, শুধু শাকিলের দায়মুক্তির পক্ষে যেন যুক্তিখণ্ডন। কোন শোকাভিভূত স্বামী বা প্রেমিক স্ত্রী/প্রেমিকার মৃত্যুর পরদিন এমন বিশাল রচনা লিখে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করে, তা আমার জানা নেই।

অংকন চলে গেছে, রেখে গেছে তার অর্জনগুলো। এই ছোট জীবনে সে বহু মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছে তার বিভিন্ন ভালো কাজের মাধ্যমে, তার পরোপকারী মনের বিশালতার মাধ্যমে। She set an example to us. এমন একটি মিষ্টভাষী, মেধাবী, প্রতিভাবান এবং ভালো একটা মানুষ হঠাৎ করে শুধু চলেই যায়নি, আমাদের সকলের ভিতর থেকে একটা অংশ সাথে করে নিয়ে গেছে। সেই শূন্যতা এক জীবনে পূরণ হবে কিনা জানা নেই।

অংকনের মৃত্যু প্রতিনিয়ত কাঁদাচ্ছে আমাদের, ভাবিয়ে তুলেছে নানাভাবে। অংকন আত্মহত্যা করেছে না নাকি খুন হয়েছে সে বিতর্কে আমরা যাচ্ছি না। আমরা শুধু চাই অঙ্কনের মৃত্যু-রহস্যের সুষ্ঠু আইনি তদন্ত হোক। চোখের সামনে এমন তরতাজা, প্রাণচঞ্চল, তরুণ একটা প্রাণের বিনাশ আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমরা এটাই চাই আমাদের সবার সামনে এত সম্ভাবনাময় একটা মানুষের মৃত্যু রহস্যের জালে চাপা না পড়ুক। অংকনের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে আমরা অংকনের পরিবারকে সাথে পাচ্ছি না। পেলে হয়তো অনেক কিছু অনেক সহজ হয়ে যেত। সামাজিক নানা অনেক কারণে এবং কমিউনিটির অনেক জায়গা থেকে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরিবার নিশ্চয়ই ভরসা পাচ্ছে না, কিংবা কোনো হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এখানে দায়িত্বটা তাই আমাদের কাঁধে, অংকনকে ন্যায়বিচার এনে দেওয়ার। এই লড়াইয়ে আমরা আপনাদের পাশে চাই।

We hope justice will be served to her. We will alway remember you Ankan Biswas.

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *