December 23, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নরসিংদীতে নারীর উপর হামলাকারীরা গুটিকয় নয়, জনসংখ্যার বিশাল অংশ 

আমিনা সুলতানা সানজানা ।। কেউ টিপ পরলে লাঞ্ছিত করবে, এখন স্লিভলেস ধরে নগ্ন করছে। অথচ আমার মা খালারা অবাধে স্লিভলেস পরে ঘুরতেন। অনেক নব্য মৌলবাদী আবার অস্বীকার করবে, বলবে তাদের মায়েরা কখনো পরেইনি এমন ‘অশ্লীল’ পোশাক।

শাড়ি পরলে কখনো না কখনো পেট দেখা যেতেই পারে, এটা দেখেই আমরা বড় হয়েছি, কিন্তু এখন সবাই এতো জাজমেন্টাল কেন? নারীর পোশাক আর অশ্লীলতা নিয়েই বা এতো মাথা ব্যাথা কেন? শালীনতার একমাত্র বাহক কি নারীই? নারীর শরীরই সভ্যতার মাপকাঠি? এবং দুঃখজনক হলেও সত্য বিশাল সংখ্যক নারী গোষ্ঠীই এটা মনে করে।

সভ্যতার শুরুর দিকে মানুষ রোদ, বৃষ্টি, ঠান্ডা, গরম, জীবাণু, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে বাঁচার জন্য পশুর চামড়া, গাছের পাতা ইত্যাদি গায়ে জড়ানো শুরু করে। তারপর সময়ের পরিক্রমায় মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার সাথে সাথে পোশাকের ব্যাপারেও সচেতন হতে থাকে।

প্রজাতন্ত্র জর্জিয়ায় গুহায় আজ থেকে প্রায় ৩৪ হাজার বছর আগে রঙ করা কাপড়ের মতো বস্তু পাওয়া যায়। ঠিক কখন থেকে এখানে কাপড়ের বুনন হয় তা আজও রহস্য। বর্তমান “হোমোসেপিয়েন্স ” প্রজাতির মানবের আগে নিয়ান্ডারথালস প্রজাতির মানব ছাগলের মত এক ধরনের পশুর চামড়া গায়ে দিতো বলে গবেষকরা ধারণা করেন। সেটাও এখনো পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায়নি।

কিন্তু কাপড়ের আবিষ্কার যে বিভিন্ন রোগবালাই, রোদ-বৃষ্টি, ঠান্ডা-গরম থেকে বাঁচতে সৃষ্টি হয়েছে তার কোনো মতভেদ নেই এবং যারা একটু চিন্তাশীল তারা সহজেই ব্যাপারটা অনুমান করতে পারবেন।

সভ্যতার প্রথম দিকে কিন্তু ধর্মের কোন প্রচলন ছিল না এই পৃথিবীতে। সমাজ-সংস্কৃতি মানবের কল্যাণে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলার জন্য ধর্মের উপস্থিতি। তাহলে স্পষ্ট প্রমাণিত কাপড় আগে এসেছে, ধর্ম পরে।

এ ধর্মের কারণে দেখা গেছে বিভিন্ন জাতি, ধর্মের লোকজনের মধ্যে কাপড়ের ধরণও বিভিন্ন হচ্ছে। একটা দীর্ঘ সময় পর সবাই যার যার কাপড় ও জীবনাচরণের ব্যাপারে সহনশীল ও একমত হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সুসময় বেশি দীর্ঘ হয়নি।

হিন্দুদের শাঁখা-সিঁদুর, খ্রিস্টানদের শার্ট প্যান্ট, মুসলমানের বোরকা টুপি একই পৃথিবীতে থেকেও যেমন সহনশীলভাবে অনেকে মেনে নিয়েছে ঠিক তেমনি অনেকে উগ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ প্রত্যাখ্যান থেকে শুরু যত হানাহানি, একজনের উপর আরেকজনের দোষারোপ এবং বর্তমানে যা চরম অবক্ষয় দিকে চলে যাচ্ছে।

শুধু ধর্ম নয় পোশাকে প্রভাব ফেলে দেশ ও জাতির। বাঙালি মাকে আমরা শাড়িতে দেখেই অভ্যস্ত এখন কোথাও কোথাও শুনি শাড়ি ও নাকি অশালীন পোশাক। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে মুসলিম নারীরাও শার্ট প্যান্ট পড়েন। ইসলামে নারীর চেহারা দেখানোতে বাধা নিষেধ আছে, তা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম নারী হিজাব করেও চেহারা দেখাচ্ছেন । এটা তার পছন্দ। তাহলে আপনি যদি ইসলামের সব আদেশ না মানেন, আরেকজন স্লিভলেস পরলে বা এমন কোনো পোশাক পরলে যা আপনার চোখে শোভন নয়, তাকে নিয়ে আপনি কথা বলার অধিকার কি রাখেন?

সবই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হয়, হবে, হচ্ছে; এটাই স্বাভাবিক। এগিয়ে যাবে এই সত্য মেনে নিতে না পারাই অস্বাভাবিক, পশ্চাৎপদতা।

এক সময়ের নায়িকা কবরীর স্লিভলেস ব্লাউজ কিন্তু কারো চোখে খারাপ লাগেনি, যে মা খালারা কবরীকে দেখে ববিতাকে দেখে স্লিভলেস ব্লাউজ পড়তেন, তাদেরই মত চেঞ্জ হয়ে একসময় হিজাব চলে আসে মাথায়। তাদের ভালো লেগেছে তারা পরেছেন। কারো লাগেনি সে পরেনি। সবার মতামত ভালোলাগা এক হতে হবে তা তো নয়। এটা ২০২২ সাল, এখনো যদি আমরা আরেকজনের মতামতকে সম্মান দিতে না জানি, তাহলে আর কবে?

প্রত্যেকটি ধর্মই অন্য ধর্মকে সম্মান করতে শিখিয়েছে। অন্যের মতকে সহনশীলভাবে মানতে শিখিয়েছে। ঠিক তেমনভাবে সমাজে মৌলবাদ ও উগ্রতাও ঢুকে পড়েছে। সহনশীলতা ব্যাপারটা একেকজন নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের বেলায় যেটা সঠিক অন্যের বেলায় সেটা সঠিক মনে হচ্ছে না। আজকে যাদের চোখে কারো পেট, কারো স্লিপলেস কাপড় অশ্লীল, অন্য কারো কাছে হয়তো আপনার চেহারা দেখানোও অশ্লীল মনে হতেই পারে।

খুব মজা নিয়ে দেখলাম সেদিন একজন ইচ্ছামতো আরেক মেয়ের কাপড় নিয়ে যা না তাই লিখছে এবং আমি তার নিজের মেয়েকে হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি নিজের চোখে। অভদ্র নই তাই ছবি তুলে প্রমাণ দিলাম না। সমাজে বুঝে না বুঝে এরাই বিষ ছড়াচ্ছে। মেয়েদের পোশাক নিয়ে একটা ঘটনা ঘটে গেলে ফেসবুকে যে ধরনের কমেন্ট দেখতে পাই তাতে রীতিমতো শংকিত হচ্ছি।

টিপ পরলে নাজেহাল হতে হবে, স্লিভলেস পরলে নাজেহাল হতে হবে, কাল সালোয়ার-কামিজ পরলেও যে ওড়না ধরে টান দেবেনা, বোরকা পরলেও যে বোরকা খুলে দেখতে চাইবে না সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না। শুধু অশিক্ষিত মূর্খরা না, সমাজের শিক্ষিত অনেক ব্যক্তিকে দেখছি নারীদের উপর আঙ্গুল তুলতে একটু দ্বিধাবোধ করছেন না। তাদের ভালো লাগে না তাই আরেকজন তাদের নিজের মতো কাপড় পরতে পারবে না। হয়তো কারো আপনার পোশাক ভালো লাগে না, তখন কি আপনি সেটা মেনে নেবেন?

পরিমনির প্রেগনেন্সির ছবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে নিত্য মেয়েদের নাজেহাল হতে হয় পোশাক নিয়ে। শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও এই বিষয়ে এগিয়ে। এক নারী আরেক নারীর সম্মান রক্ষা তো দূরের কথা, নরসিংদী রেলস্টেশনে যে দশজন নারীর গায়ে হাত তুলেছিল তার মধ্যে একজন নারীও ছিল। আসলে নরসিংদীর ওই মেয়ের উপর সেদিন শুধু ওই কজন না, বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশ হামলা করেছে মস্তিষ্ক দিয়ে। তারা নারীদের ঠিক শুধু তাদের মতো দেখতে চায়, তাদের মস্তিষ্ক তাদেরকে যেভাবে দেখতে বলেছে ঠিক সেভাবে।

তাদের ধর্মীয় জ্ঞান শুধু তাদের অন্যদের বেলায় মনে পরে, নিজের বেলায় না। ইসলামে কিন্তু স্পষ্টভাবে নারীর চেহারা দেখানো নিষেধ আছে পর পুরুষের সামনে, কিন্তু তারা যখন পর পুরুষের সামনে চেহারা দেখান, তখন কিন্তু মনে পড়ে না ধর্মের কথা। মনে পড়ে না ছবি তোলা নিষিদ্ধ । মনে পড়ে না কবিতা লেখাও নিষেধ। ভ্রু প্লাক করার কথা স্পষ্টভাবে না করা আছে, তখন তাদের এসব মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে যখন কারো পোশাক-পরিচ্ছদ তাদের মনমতো না হয়।

একই সমস্যা হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সব লোকদের মধ্যে আছে। নারীর প্রতি তাদের নিজেদের মন্তব্য যে কত কুরুচিপূর্ণ সেটা তাদের চিন্তার বিষয় না।

সমস্যা যে নারীর শরীরে নয় সমস্যা যে নারীকে শরীর হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সত্য তাদের কে বুঝাবে? যখন বুঝতে পারবে তখন আর জানার পরেও কোনো লাভ হবে না। এদের এই অন্ধত্বের কারণে কাল তার নিজের গায়ে, তার মেয়ে সন্তানের গায়েও হাত উঠবে।

এ দেশটাকে, এ দেশের সংস্কৃতিকে হিন্দু-মুসলিমে ভাগ না করে, নিজের দেশ নিজের মানুষ হিসেবে যদি দেখতো তাহলে এত জাজমেন্টাল হতে পারতো না।

যারা শ্লীলতাহানি করতে পোশাকের দোহাই দেয়, ওদের মনের ভিতর এবং চোখের দৃষ্টিতে কখনোই ভালো কিছু বা শুভ কিছু থাকতে পারে না।  যখন দেখি সমাজের সর্বত্র শিক্ষিত মানুষও এ ধরনের ভয়াবহ দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন, তখন ভয় হয় নিজের সন্তানসহ সকল সন্তানদের জন্য। এই কলুষিত সমাজে কোথাও নিরাপত্তা নেই, আমরা মেয়েরা না নিরাপদ পুরুষের কাছে, না অন্য পুরুষতান্ত্রিক নারীর কাছেও!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *