November 2, 2024
কলামফিচার ৩

পুরুষতন্ত্র ও তার সেবাদাসীদের কবলে ‘অসাম্প্রদায়িক’ বাংলাদেশ

শাহাদাত রাসএল ।। বেশিরভাগ মানুষ আকাশে একটা পাখিকে ডানা মেলে স্বাধীনভাবে উড়তে দেখলে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে “ইশ পাখিটা যদি খাঁচায় এনে পুষতে পারতাম”। মানুষ এটা ভাবে এবং সাধ্য অনুযায়ী পাখিটিকে খাঁচা এনে রাখে।

মানুষ কেন এটা করে?

মানুষ এটা করে কারণ মানুষ কখনোই স্বাধীন হতে পারেনি। সে ধর্ম সমাজ পরিবার রাষ্ট্র সভ্যতা আরো অনেক কিছুতে বাঁধা পড়ে আছে। মানুষ মূলত পরাধীন। এ কারণেই সে অবচেতনভাবে পাখির স্বাধীনতায় ঈর্ষা বোধ করে। সে পাখির স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে চায়না।

ঘটনা বুধবারের, নরসিংদী রেলস্টেশনে ‘অশ্লীল’ পোশাক পরার অভিযোগ তুলে একজন নারীকে প্রকাশ্যে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করা হলো। যারা তরুণীকে পৈশাচিক আনন্দে নিগ্রহ করলো, তারা কারা?
তারা পুরুষ। তারা ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী পুরুষ। সেখানে একজন নারী অংশ নিয়েছিলেন বলে আলোচিত হলেও আমি দেখছি সেখানে সকলেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরুষ ছিলেন।

পুরুষতন্ত্র একটা দর্শন, একটা আইডিওলজি। যেটা যে কেউই ধারণ করতে পারে এবং সে সেই গোত্রভুক্ত, এখানে তার জন্মগত শারীরিক লৈঙ্গিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ না। তার আদর্শটা গুরুত্বপূর্ণ। আক্রমণকারী নারীটি হাজার বছর পুরুষতন্ত্রের দাসত্ব করা একটা বন্দি চরিত্র মাত্র, যে এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও পুরুষতন্ত্রের বেঁধে দেয়া গণ্ডির বাইরের জীবন সম্পর্কে জানে না। এই নারীটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খাঁচা বন্দি সেই পাখিটি যে আকাশে স্বাধীনভাবে কোনো পাখিকে উড়তে দেখলেই তার সীমাবদ্ধ জীবনের সুপ্ত ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এবং সে জানে নিজেকে পুরুষতান্ত্রিক খাঁচা থেকে মুক্ত করা কঠিন, তার চেয়ে সহজ মুক্ত পাখিকে খাঁচাবন্দি করে নিজের কাতারে নিয়ে আসা। আর এই প্রক্রিয়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আক্রমণকারী নারীটির পাশেই থাকবে। থাকবে তার নিজের স্বার্থেই। এবং পুরুষতন্ত্র তার ইচ্ছে বাস্তবায়ন করার জন্যেই এমন অসংখ্য নারীকে তৈরি করবে নারীর প্রতিপক্ষ হিসেবে, এবং ভালো দাসী হিসেবে নিজেকে যে প্রমাণ করতে পারবে, তার গলায় দেবে ‘ভদ্র সভ্য নারী’র মেডেল।

পুরুষতন্ত্র পুরুষাঙ্গ থাকা না থাকার সাথে সম্পর্কিত না। যেমন ওখানে সেদিন দুজন পুরুষ ছিলেন যারা সেই সময়ে পুরুষতন্ত্রের পাহারাদার না হয়ে বরং নিপীড়িত তরুণীটিকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন এবং সেটা করতে গিয়ে তারাও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সাধুবাদ সেই দুজন তরুণের জন্য যারা বন্ধুর প্রতি হওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠর অন্যায়কে মাথা নত করে মেনে নেন নি।

আরেকটা ব্যাপারে কথা বলি। ধরুন, এক সময় ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ছিল না। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা আদিবাসী ও অন্যান্য ধর্মের মানুষেরাই এই অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। তারপর কালক্রমে ইসলাম এলো। এদেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলেন। এবং আজকে দেখা যায় যে বাংলাদেশে যাদের পূর্বপুরুষ কনভার্টেড মুসলিম, তারা কথায় কথায় ইসলামের আঁতুরঘর সৌদিআরবের সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদারনীতিক অবস্থানকে খারিজ করে দেয়। এবং ইসলাম রক্ষায় বা নিজেকে মুসলিম প্রমাণ করার জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা বাংলাদেশি মুসলিমরা করে থাকে এই চেষ্টাটা আরবরা করে না।
কারণ আরবদেরকে প্রতিদিন নিজের মুসলিম আইডেন্টিটি নিয়ে আতংকে থাকতে হয়না। প্রতিদিন তাকে সহি মুসলমান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের এটা প্রমাণ করতে হয়। কারণ তার পূর্বপুরুষের ধর্মীয় পরিচয় যাতে কেউ বুঝে না ফেলে। যাতে কেউ তার মুসলমানিত্ব নিয়ে প্রশ্ন না করে। নিজের সহি মুসলিম হবার প্রতি যাতে কেউ সন্দেহ না করে। এর কারণ তার নিজের হীনমন্যতা।

পুরুষতান্ত্রিক দাসত্বের শিক্ষায় শিক্ষিত একজন নারীর অবস্থা সেই নও মুসলিমটির মতো। তাকেও তার প্রতিদিনের কাজের মাধ্যমেই পুরুষতন্ত্রকে বোঝাতে হয় যে “দেখো আমি নারী হলেও পুরুষতন্ত্রের একজন যোগ্য দাসী হয়ে উঠেছি”। এই নারীটিকে মাঝে মাঝে বরং পুরুষদের চাইতেও বেশি পুরুষ হয়ে উঠতে হয়। তাকে এই দায়িত্ব ভার পুরুষরাই দিয়েছে। এবং এই নারীটি মূলত দম দেয়া একটা যন্ত্র মাত্র। এরকম যন্ত্রকে আপনি তার লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে বিচার করতে পারবেন না। আমাদেরকে আগে প্রশ্ন করতে হবে তাদের দর্শন নিয়ে, তাদের ভেতর এই আক্রমণাত্মক হিংস্র দর্শনটা কারা ঢুকিয়ে দিল এবং দিচ্ছে, এই জায়গাটা নিয়ে কথা বলা জরুরি।

আজকে কোনো নারীকে তার পোশাকের জন্য আক্রমণ করার ক্ষেত্রে বারবার যে কথাটা আক্রমণকারীদের মুখে শোনা যায় সেটা হচ্ছে ‘‘এটা একটা মুসলিম প্রধান দেশ, তাই এখানে এমন কোনো পোশাক পরা যাবে না যেটা ইসলাম সম্মত নয়’’।
যদি নারীর পোশাক সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষের ইচ্ছেমতোই পছন্দ করতে হয় তাহলে উল্টোদিকে তাকিয়ে ভাবুন যেসব দেশে খ্রিষ্টান হিন্দু বা ইহুদী প্রধান, সেইসব দেশে যদি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার অহংকারে মানবাধিকারকে পায়ে পিষে ফেলা ধার্মিকদের এই ফর্মুলাই অ্যাপ্লাই করা হয়, তাহলে সেসব দেশে কী আইন হওয়া উচিত? হিন্দু বা খ্রিষ্টান প্রধান দেশে যদি আজকের নরসিংদী রেলষ্টেশনের মতোই ‘খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অ-খ্রিষ্টানসুলভ পোশাক পরা যাবে না’ এই শ্লোগান দিয়ে কোনো মুসলিম নারীকে বোরকা পরার অপরাধে টেনে হিঁচড়ে নগ্ন করে মারধোর করে কোনো খ্রিস্টান বা হিন্দু, তখন আবার আপনারাই ‘এখন মানবতা কোথায়’ বলে বলে নিরাপত্তা ভিক্ষা চেয়ে বেড়াবেন না তো? সহ্য করতে পারবেন ?
সহ্য করা কিন্তু উচিত, কারণ সংখ্যাগুরুর ইচ্ছেমতো অন্যকে চলতে হবে – এই ফতোয়া তো আপনাদেরই দেয়া।

আর বাঙালি মুসলিম পুরুষ ধর্মের জন্য কী কী করে এটা একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো!

নাসিরনগর দেখতে পাচ্ছেন? মন্দিরে মাঝরাতে কোরান রেখে আসা দেখতে পাচ্ছেন? হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ইহুদী এদের বিরুদ্ধে ভয়ংকরতম অমানবিক ওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন? নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে হুংকার শুনতে পাচ্ছেন? নারীদের বাইরে অফিস আদালতে কাজ করার বিরুদ্ধে ফতোয়া শুনতে পাচ্ছেন? স্রেফ ইসলামসম্মত নয় নারীদের এমন পোশাকের জন্য তাদেরকে বেশ্যা বলে চিহ্নিত করে দেয়া হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন?
এইগুলোকেই তারা জান্নাতে যাবার পাথেয় হিসেবে মেনে নিয়েছে।
অথচ এদেশে প্রতিদিন এতো এতো ধর্ষণ কারা করে? কাদের দুর্নীতির কারণে দেশ বারবার দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়? তারা কোন ধর্মের অনুসারী? গত সপ্তাহেই বোরকা পরে ইয়াবা ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা পড়লেন একজন নারী। তিনি তো পর্দানশীন। বাহ পর্দা! সারাদিন রাস্তাঘাটে ওয়াজে মাহফিলে খুতবায় মানুষকে সৎ চরিত্রের সবক বিলিয়ে মাদ্রাসায় ফিরে গিয়ে শিশুদেরকে ধর্ষণ করে কোন বেপর্দা মানুষেরা? মাদ্রাসায় প্রতিদিন অসহায় এতিম শিশুদেরকে ধর্ষণ করার সংবাদ দেখতে পাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ইসলামের ঠিকাদারদেরকে দেখলাম না রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে। কেন এসবে ইসলাম আহত হয় না?

বরং ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত বসুন্ধরা’র গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মুসল্লি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হতে দেখেছি আমরা। এবং আগামীতে পাঁচ হাজার মুসল্লিকে নিয়ে তার হজে যাবার ঘোষণাও দেখতে পেয়েছি। এই ক্ষেত্রে ইসলামের মানহানী হয় না?

এদের দিকে আঙুল তুললে তো রিজিকে টান পড়ে যাবে। যেখানে ভিক্ষে জোটে, সেখানে সব হালাল?
কিন্তু নারীর পোশাকের দিকে আঙ্গুল তুললে তো ধর্ম ব্যবসায়ী পুরুষতান্ত্রিক হায়েনাদের কোনো ক্ষতি নেই। কেউ তাদেরকে অনাধিকার চর্চা বা অন্যের শ্লীলতাহানীর কারণে বিচারের আওতায় আনবে না, সেই নিশ্চয়তা তারা পেয়ে গেছে। পেয়ে গেছে কারণ এইসব ঘটনায় আইন সংবিধান কী বলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন ধর্মের লোকের পকেটে কত পার্সেন্ট ভোট। এই একটা হিসেবে এ দেশের সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থান সহোদরের।

শেষটায় সাংবাদিক নাজনীন মুন্নির একটা কথার প্রতিধ্বনি করতে চাই
“রাস্তাঘাটে, রেল বা বাসস্টেশনে ঘোমটা মাথায় দেওয়া ছাড়া চলতে পারবো না? যদি চলি তাহলে এই অবস্থা হবে? জামা টেনে ছিড়ে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে? রাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট জবাব চাই, এখন থেকে এটাই দেশের বিধান কিনা– ওই প্রশ্নের উত্তর পেলে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের এখন কী করণীয়, আমরা বুঝতে পারবো এক অসম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের সমর্থন আদায় কতখানি প্রতারণা ছিল”!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *