নারী লেখক এবং মানুষ সত্তা
আঞ্জুমান রোজী ।। ‘মানুষ’ শব্দটার মধ্যে আছে আত্মসচেতনতা, বিবেকবোধ সম্পন্ন হওয়া, নিজেকে জানার ও বোঝার গভীরতা, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং জ্ঞানগরিমায় নিজেকে বিকশিত করা। এ সমস্ত বৈশিষ্ট্য সহযোগে স্বাধীন সত্তা নিয়ে গড়ে ওঠে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এজন্য আমরা কথায় কথায় বলি, মানুষ হ। মানুষ হয়ে গড়ে উঠার বিষয়টি নারীপুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য। যদিও বাস্তবে মানুষ হওয়ার কারিগরি শুধু পুরুষের বেলায় প্রয়োগ হয়। নারীর বেলায় নারী শুধু-ই নারী। তারপরও কিছু নারী মানুষ-সত্তা নিয়ে গড়ে উঠছে, ভেঙ্গে দিচ্ছে সকল বাধার প্রাচীর। এদের সংখ্যা খুবই নগন্য। অধিকাংশ নারীই বেড়ার মধ্যে থাকতে ভালোবাসেন। এরা বেড়ার মধ্যে থেকেই শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা করেন। আবার স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে লেখালেখির কাজও করে যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবে এদের পরনির্ভরশীলতা কমে না, যা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার পথে পরিপন্থী।
যখন একজন নারী ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে না-পারে তখন সেই নারী যতবড় লেখকই হোক না কেন তার কোনো লেখা তো দূরে থাক তার ব্যক্তিত্বও আমাকে টানে না; ঠিক সেভাবে একজন পুরুষ লেখকও যখন ‘মানুষ’ না হয়ে পুরুষ হয়ে থাকে তাকেও আমি দূরে ঠেলে দেই। প্রাকৃতিক নিয়মে আমি একজন নারী বটে, ঠিক যেভাবে একজন পুরুষের জন্ম। ভেদাভেদটা শুধু শরীরবৃত্তীয়। কিন্তু মননের জায়গায় বা সৃষ্টিশীল জায়গায় নারীপুরুষের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ভেদাভেদ করে এবং এই ভেদাভেদে অনেক নারী লেখকও একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। অথচ সৃষ্টিশীল মননশীল জায়গায় নারীপুরুষ সব একাকার হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একজন নারী যখন পূর্ণাঙ্গ ‘মানুষ’ হওয়ার অভিপ্রায় রাখেন না তখন তার সৃষ্টিশীল কোনো কাজও গুরুত্ব পায় না। আমি এমন নারী লেখক খুঁজে বেড়াই, যার ভেতর ‘মানুষ’ হয়ে বেঁচে থাকার পাশাপাশি মাথা উঁচু করে চলার প্রবণতা প্রবল। আমি তাঁদের কাছেই যাই এবং তাঁদেরকেই কাছে টানি।
অনেক নারী লেখক ‘নারীবাদ’ বিষয়টাকে উপেক্ষা করেন। বলেন, এটি একটি ক্লিশে বিষয়। আরো বলেন, নারী নারীর মতো থাকবে, পুরুষ পুরুষের মতো থাকবে। নারী পুরুষে এতো সমান সমানের কি আছে? প্রাকৃতিকভাবে নারী একটা আলাদা সত্তা, তাকে তার মতো করেই থাকা উচিৎ; এই মানসিকতা নিয়ে অনেক বিখ্যাত নারী লেখক আছেন। তাদের অনেকেই পারিবারিক পরিবেশে পুরুষের আনুকূল্য পেয়েছেন, পেয়েছেন আদর সোহাগ, এমনকি কেউ কেউ প্রচুর স্বাধীনতাও পেয়েছেন, সেই মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা সাহিত্য রচনা করেছেন বা করে যাচ্ছেন। যার কারণে ‘নারীবাদ’ বিষয়টি তাদের মাথায় আসেনি। নারী জন্মেই যুদ্ধ করে এমন পরিবেশ এসব নারী লেখক কল্পনাই করতে পারেন না। এটা কি তাদের ভাগ্য বলবো নাকি আমি তাদের ভাগ্যকে হিংসে করবো? অথচ আপামর জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশ নারী। সেই বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্বকারী হচ্ছে ঐসব নারী লেখক। এখন কথা হলো, এই বৃহৎ অংশের নারীরা সবাই কি আদরে আহ্লাদে বড় হচ্ছে! পাচ্ছে কি সামাজিক এবং পারিবারিক মর্যাদা! এমন অনেক প্রশ্ন আসে মাথায়।
বিশেষ করে লেখালেখির মাধ্যমে একজন নারী লেখক যদি ‘মানুষ’ হিসেবে নিজেকে দেখাতে না পারেন, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবে কেমন করে? আমরা যারা লেখালেখি করি, তাদেরকে অনেক সময় প্রশ্ন করা হয়, কেন লেখালেখি করি কিংবা এর উদ্দেশ্য কি? অনেকেই উত্তরে বলেন, “ভালো লাগে তাই লিখি। লিখলে নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো মনে হয়। একটা কিছু লেখার পর খুব রিলাক্সড লাগে।” তারপর? এরপর চুপ করে থাকে। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি চান না আপনার লেখা অন্য কেউ পড়ুক? “অবশ্যই চাই। তবে কে পড়বে আর না পড়বে, সে আশা করে তো লিখি না! লিখি আর কি!” এক্ষেত্রে এমন নারী লেখকদের বলবো, আপনাদের লেখা ডায়রির মধ্যে বন্দি করে রাখুন। এখানে একটা প্রশ্নও জুড়ে দিতে চাই, শিল্পের সুষমা ছড়ানোর জন্যই কি লেখালেখি! আনন্দ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যই কি সাহিত্য রচনা! তাহলে সে লেখা সিন্দুকে তুলে রাখুন। বিশেষ করে নারী লেখকদের লেখা।
নারী পুরুষ যারাই লেখালেখি করুক না কেন এর একটা প্রভাব সমাজে পড়বেই। পাঠক পড়ামাত্রই নিজ মননের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে। এমতাবস্থায় লেখকদের কী ভাবা উচিৎ? অবশ্যই সব লেখকই চায়, তার লেখাটা যেন পড়া হয়। লেখালেখি হলো সমাজের দর্পণ। পাঠকও সেখানে নিজেকে দেখে, লেখকও সেখানে নিজেকে দেখে। তাই লেখালেখির উদ্দেশ্যেই হলো অর্জিত জ্ঞান, তথ্য, আবেগের যাত্রাপথ সবই অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। এই বিলিয়ে দেয়ার মধ্যদিয়ে লেখক সামাজিক সচেতনতায় বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে নারী লেখকদের মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা না দেখা গেলে, নারী সমাজের পথ মসৃণ তো হবেই না, এমনকি অবুঝ নারী সমাজ বুঝতেও পারবে না তারাও যে ‘মানুষ’।
এমনই অনেক নারী লেখক আছেন, যারা ‘নারীবাদ’ বুঝতে চান না। ‘নারীবাদ’ অর্থ যে নারীর ‘মানুষ’ হওয়ার একটি দিক, এই দিকটি দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক নারী লেখক তা মানতেই চান না। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ গুলিয়ে এ সমস্ত নারী লেখক যাই লিখুক না কেন, তারা যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন সে সমাজে তা কোনো গ্রহণযোগ্যতা রাখে না। যদি রাখতোই তবে আজকের বাংলাদেশে নারী সমাজের এমন অধঃপতিত রূপ দেখতে হতো না।
বেগম রোকেয়ার সময় থেকে তো অনেক সময় গড়িয়েছে। নারী সমাজের পরিবর্তনের যে ছিটেফোঁটা দেখছি তা পুঁজিবাদী শ্রেণিতে আবদ্ধ। অধিকাংশ নারী লেখক নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য লিখে যাচ্ছেন। আর এজন্য পুরুষের সঙ্গেই তাদের আপোষ করতে হচ্ছে। তাই তারা ‘নারীবাদ’ বিষয়টি লেখাতে আনা তো দূরে থাক, মুখেও আনেননা। তাদের এমন লেখক স্বীকৃতি দিয়ে কি হবে নারী যদি নারীমুক্তির পথ না দেখায়! এসব নিয়ে ভাবি আর অস্থির হই। সেইসাথে নারী হয়ে জন্মানোর শত পাপ মাথায় বয়ে বেড়াই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]