“এই দেশে মেয়েদের অধিকারের তো অভাব নাই”
প্রিয়া দেব ।। “এই দেশে মেয়েদের অধিকারের অভাব নাই” – আমাদের দেশে সবচেয়ে অদ্ভুত মিথ সম্ভবত এটাই। নানা ইস্যুতে যখন কোথাও নারীকে ভিলেন হিসেবে আমরা দেখি তখন কিভাবে কিভাবে যেন এই দেশের নারীদের নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। এই দেশের যে নারীটি গলার আওয়াজ তুলে কথা বলতে জানেন, যে নারীটি মর্জিমতো পোশাক পরতে পারেন, সমাজের তোয়াক্কা না করে নিজের জীবন নিজের মতো গুছিয়ে নিতে জানেন, সেই নারীটিকে তখন মডেল হিসেবে দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় এই দেশে নারীকে ঠিক কতোটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এই দাবি করার আগে শিক্ষিত অশিক্ষিত কিংবা স্বশিক্ষিত সকলেই একসাথে যে জিনিসটা বেলালুম ভুলে যান তা হলো স্বাধীনতা জিনিসটা নারীকে দেওয়ার তারা কেউ না। একজন নারী একজন মানুষ, আর একজন মানুষ নিজের মতো বাঁচার শতভাগ অধিকার নিয়েই জন্মায়। এই দেশে নারী নির্যাতন দমন আইন নামে আলাদা একটা ট্রাইবুনাল আছে, এটাও বিরাট এক সমস্যার বিষয় মানুষের কাছে, দুদিন পর পর পরিসংখ্যান খুঁজে তারা বের করার চেষ্টা করেন এই ট্র্যাইবুনালে করা কতগুলো মামলা ভুয়া, যেন মামলা কয়েকটা ভুয়া হলেই এদেশের তাবৎ নারীকূল কোনোরকম নির্যাতনের শিকার হয় না এইটা প্রমাণ করা সহজ হয়ে যায়। এরকম অসংখ্য আচরণ আছে এই দেশের মানুষের, যে আচরণ প্রমাণ করে নারী যে নির্যাতিত হয় এই জিনিস তারা মানতে চায় না।
বাংলাদেশে বর্তমানে কয়েকটা ঘটনার দিকে ফোকাস করি, একটা দেশে একটা মেয়ে কী কাপড় পরে রাস্তায় হাঁটবে এটা নিতান্তই ওই মেয়ের ব্যাপার। কোনো মেয়ে যদি অসহ্য গরমে স্পেসিফিক কারো চোখে সভ্য হতে বস্তা না পরে ঘুরতে চায় তবে ওইটা অবশ্যই সেই মেয়েটির স্বাধীনতা। কিন্তু আমাদের দেশে সেটাও সম্ভব না। আগে দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিচে আমরা মেয়েদের পোশাক নিয়ে নানারকম নোংরা মন্তব্য দেখতাম, হোক সে নিউজে কোনো মডেল কিংবা সাধারণ মেয়ে, সেই মেয়ের কাপড় নিয়া চর্চা হবেই। মেয়ে যদি জিন্স টি শার্ট পরে তবে একদল মেয়ে ওড়না দিলো না কেন এই নিয়ে মন্তব্য করতো, মেয়ের পরিবার, শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলতো, ক্ষেত্রবিশেষে এই মেয়েকে ধর্ষণ করা উচিত এমন মন্তব্যেরও কমতি ছিল না। আবার ধরেন মেয়ে সালোয়ার কামিজ পরেছে তবে ওই মেয়ে কেন বোরখা পরলো না এই নিয়ে মন্তব্য শুরু হয়ে যেত, পরের প্যাটার্নটা সেই আগের মতোই ধর্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে শেষ হতো। মেয়ে হিসেবে এই দেশে আপনার অবস্থান ঠিক কিরকম তা এসব অনলাইন নিউজ পোর্টালের কমেন্ট দেখলেই আপনার পরিষ্কার হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এখন শুধু অনলাইন নিউজ পোর্টালের কমেন্টেই আপনার চরিত্রের পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে না, এখন রাস্তাঘাটে সমাজ সংস্কার আর ধর্মরক্ষার দায় ঘাড়ে তুলে নিয়ে মানুষ এগিয়ে আসছে মেয়ে হিসেবে আপনার কাপড় ধরে টান দেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিগত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষন করুন, রাস্তাঘাটে নানাভাবে মেয়েদেরকে হ্যারাস করা হচ্ছে মেয়েদের পোশাকের উপর প্রশ্ন তুলে। নরসিংদীর রেলস্টেশনে যেভাবে একটা মেয়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলে মেয়েটার দিকে আগ্রাসী ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো মানুষ – একবার ভাবুন তো ঠান্ডা মাথায় দৃশ্যটা, একবার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করুন, শুধুমাত্র পোশাকের কারণে একজন নারীকে এরা যা খুশি তা করা যায় ভেবে নিয়েছে। এখানে এদের কারো উদ্দেশ্য কিন্তু সমাজ কিংবা ধর্মরক্ষা না, যদি তাই হতো তবে এভাবে মেয়েটার দিকে তেড়ে যেত না এরা। এখানে এই আগ্রাসী মনোভাবের পেছনের কারণ একটাই, সেটা হচ্ছে নারীর প্রতি এই সমাজের নিচু দৃষ্টিকোণ। এই সমাজ ধরেই নিয়েছে তাদের যাবতীয় ইচ্ছা মর্জি সব তারা নারীর উপর চাপিয়ে দিতে পারে, এই সমাজের সব সংস্কারের দায় শুধুই নারীর আর নারী এই মানুষগুলোর হিসাবমতো না চললে নারীর প্রতি হিংস্র হওয়াটাও এই সমাজ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।
নরসিংদী রেলস্টেশনে ওই মেয়েটার দিকে তেড়ে আসা মহিলা কিংবা কদিন আগে বাসে টি শার্ট পরা মেয়েটাকে হেনস্থা করা মহিলা, এই দুই মহিলার প্রতি সমবেদনা দেখানো লোকের সংখ্যাই কিন্তু এ দেশে বেশি। ওই নারীদের সপক্ষে গান কবিতা পর্যন্ত বানানো হয়ে গেছে, এই প্রতিটা আচরণের মানে দাঁড়ায় পোশাকের জন্য এইভাবে একজন নারীকে হেনস্থা করাকে এই সমাজ সঠিক মনে করে। এই সমাজের মনেই হয় একটা মেয়েকে পোশাকের জন্য হেনস্থা করাটাই উচিত। সমাজ তার লেন্সে নারীকে দেখতে চায়, তার হিসাবে নারীকে রাখতে চায়। আর এই হিসাবে একটু গড়মিল হলেই তারা হিংস্র হয়ে ছুটে যায় নারীর দিকে। এজন্য নারীদের উচিত সমাজের নারীদের জন্য বানানো পৃথিবী থেকে বের হয়ে আগানো। শুধু কয়েকটা মানুষ বাহবা দেবে বলে পোশাকের মাপ সমাজের হিসাবে ঠিক করতে বসে গেলে দিনশেষে কিন্তু লাভ হবে না, কারণ এই যে পরাধীন করার চাহিদা তা কিন্তু দিনদিন বাড়তেই থাকবে।
আজকে আপনার পোশাক নিয়ে পড়েছে, কালকে আপনার বাইরে বের হওয়া নিয়ে পড়বে,এরপর তারা ঠিক করতে আসবে আপনি পড়াশুনা করবেন কি করবেন না। এজন্য এই চক্র ভাঙতে হবে, বর্তমানের কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হবে। এই দেশ আসলেই নারীর জন্য নিরাপদ না, যারা নারীর পোশাক ধরে আজকে টান দিতে যাচ্ছে, মনে রাখতে হবে এদের সংখ্যাই সমাজে বেশি, এরা বাড়ছে,তাই প্রতিবাদটা বাড়াতে হবে। আইন কী করবে, রাষ্ট্র কী করবে তা ভাবার আগে আমাদের ভাবতে হবে মানুষ হিসেবে আমরা কী করবো। আজকে আওয়াজ আমাদের সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে তুলতে হবে, কদিন পর পর ট্রেন্ডে সব ভুলে যাওয়া জাতির মাঝখানে থেকেই এই ঘটনাগুলো মনে রাখতে হবে, মনে করিয়ে দিতে হবে বারবার, কারণ নারীর জন্য দিনদিন ভয়ংকর হচ্ছে এ দেশ। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করাটাই অস্ত্র, চুপ না থেকে এজন্য নিজের সাধ্যের মধ্যে থেকেই এইসব মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে আমাদের। নিজেদের সমস্যাগুলোকে দেখিয়ে দিতে হবে, যেকোনো ইস্যুতে ‘নারীরা এদেশে অনেক ভালো আছে’ – এমন মন্তব্য করা মানুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে আসলে কতোটা ভালো আছে নারীরা। এদেশ বদলাক, এদেশ নারীদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠুক, আর এই নিরাপদ করার লড়াই নারীকেই করে যেতে হবে, নিজের অধিকার আদায় করা থেকে কোনোভাবেই পিছনে সরা যাবে না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]