‘স্লাট শেইমিং’ এর সেকাল একাল
অপর্ণা হাওলাদার ।। একাল থেকেই শুরু করি? গত কয়েক বছরে আমার পিএইচডি চলাকালীন সময়ে ফেসবুকে আমার অনেক পোস্টে প্রাক্তন সহপাঠী কেউ কেউ খুব নোংরা কথা লিখে যেতেন। অনেকটাই দ্বিধাসংকোচের সাথে স্বীকার করি, এই কমেন্ট যারা লিখতেন তারা সবাই নারী। মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, আমি যেহেতু বাইরে একা আছি, তাই আমার চরিত্র সম্বন্ধে যে কোনো মন্তব্য করাই যায়। বিরক্ত হতে হতেই একসময় ভাবছিলাম, এই যৌনতানির্ভর শরীর সম্বন্ধীয় টিটকারির শুরু কবে থেকে? একজন নারী যখন আরেকটি নারীকে “বেশ্যাকরণ” করেন, তার কারণ ও উদ্দেশ্য কী? একটি সমাজ যখন “বেশ্যাকরণ”কে বৈধতা দেয়, তার উদ্দেশ্য কী? ভাবতে গিয়ে মনে হলো যেদিন থেকে জন্ম নিয়েছি তখন থেকেই তো বেশ্যাকরণের এই মহাযজ্ঞের ব্যাপার জানি মনে হচ্ছে! তখন থেকেই এর থেকে নিজেকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তা নিয়ে চেষ্টা করছি মনে হয়। স্লাট শেইমিং চিনতাম না, সেই সুন্দর শৈশব আমাদের অনেকেরই জোটেনি।
নার্সারিতে ভর্তি হলাম বরিশালে YWCA তে, আমার প্রথম স্কুল সেটা। একটি ছেলে কিছুদিন পর ক্লাসে ভর্তি হলো এবং তার মস্তিষ্কে কি ঘটলো কে জানে – সে “অপর্ণা” ছাড়া আর কারো পাশে বসবে না বলে ঘোষণা দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলো। আমি প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট বাচ্চা ছিলাম, একে চিনতামও না। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে নারী অভিভাবক মহলে আমাকে দেখে মুখ টিপে হাসাহাসি, উপহাস করা শুরু করলো। নার্সারির বাচ্চা হওয়া সত্ত্বেও আমি খুব পরিষ্কার বুঝেছিলাম, ছেলেটিকে নয়, কেবল আমাকেই আঙ্গুল দিয়ে কিছু একটার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটলে তা লুকিয়ে রাখতে হবে, অবচেতনে এটাও মাথাতে গেঁথে গিয়েছিল খুব অল্প বয়সে। এরপর আত্মীয়সূত্রে দুলাভাই শ্রেণীয় কিছু মানুষের বেশ যৌনতাকেন্দ্রিক কৌতুক টিটকারিও শুনতে হতো সেই শৈশব থেকেই। তা থেকেও নিজেকে রক্ষার দায় নিজেরই ছিল – বাংলাদেশে মেয়েরা মোটামুটি “আমার কাঁধেই তুলে নিলাম নির্ভরতার চাবি” সূত্র মেনে জন্ম নেয়।
বরিশালে, খোলামেলা পরিবেশের কারণেই হয়তো, নারীশিশু হ্যারাসমেন্টের সুযোগ অনেক বেশি ছিল। পাশের বাসার এক যুবক, আমার চেয়ে দশ/পনেরো বছরের বড়। আমি এবং অন্য অনেক মেয়েশিশু তাকে ভীষণ ভয় পেতাম। শরীরে হাত দেয়ার মত কিছু সে করেনি অন্তত আমার সাথে। কিন্তু চোখমুখে একটা লোলুপ ভাব আনতো সে আমাদের দেখলে। লুঙ্গিটা ঊরু পর্যন্ত তুলে জিহ্বা বের করে খুব কুশ্রী একটা মুখভঙ্গি করতো সে আমাদের কয়েকজন মেয়ে বাচ্চা দেখলে। এই ছেলেটির মত অসভ্য ধরনের না হলেও আশেপাশে আরও অনেক যুবকই ছিল যাদের যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যবহারে মেয়েদের প্রতিদিন সমঝে চলতে হতো। পৃথিবীর অন্য কিছু বোঝার আগেই আমরা এই কথাটি বুঝে গিয়েছিলাম যে এইসব পুরুষের নোংরা চোখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে। বাড়ির সামনের সিঁড়ি ছেড়ে উঠানে গেলেই মায়ের ধমক খেয়েছি এরা কেউ দেখে ফেলবে তাই, অন্যদিকে সমবয়সী ছেলেরা কোথাও কোনো বাঁধা পায়নি। ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে বায়োলজিক্যাল পার্থক্য বোঝার আগে থেকেই আমরা জানতাম নিরাপত্তাহীনতা কাকে বলে, এবং বাড়ির বড়রা কোনো অজানা কারণে এইসব পাড়ার ছেলেদের মাস্তানির দায় আমাদের কাঁধেই চাপিয়ে দেন। “তুই বাইরে না গেলে তো ও দেখতো না” এই অদ্ভুত যুক্তির মধ্যে থেকে আমরা বড় হতে থাকি। আমাদের মা জগতের সাথে লড়তে জানতেন না, বা পারবেন বলে বিশ্বাস করতেন না – তারা কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার লজ্জা ঢেকে আমাদের লক্ষণরেখায় আটকে ফেলেছিলেন।
এরপর আমি ভর্তি হলাম উদয়ন স্কুলে ঢাকায় এসে। উদয়ন কোএড স্কুল, সেইসময় ছেলেমেয়ে একত্রে বসালে পৃথিবী উল্টে যাবে, এই যুক্তিতে ছেলে আর মেয়ে সেকশন আলাদা ছিল। মেয়েদের সেকশনে কিছু নারী শিক্ষক কেবল “স্লাট শেইমিং” করতেই আসতেন। যেমন, ক্লাস এইটে একদিন টিফিন পিরিয়ডে আমরা কেউ কেউ জানালায় শিকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। এক শিক্ষক হঠাৎ ঢুকে বললেন, “কি অবস্থা! কাকাতুয়ার মেয়েরা জানলা থেকে নিচের ড্রাইভার দেখে!” এইরকম সহজেই মেয়েদের চরিত্র খারাপ কথাটা বলতেন কেউ কেউ, এইসবের প্রতিবাদ করা যাবে, সেই সম্ভাবনাও আমরা জানতাম না। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা যদি জন্ম হয় আমার মত কোনও মাইনরিটি পরিবারে। মেয়ে কখন মুসলিম ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে, এই তুমুল সংকটে প্রতিদিন পরিবারের সবাই তটস্থ করে রাখেন। অথচ, আত্মীয় পুরুষের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের (গায়ে হাত দেওয়া) অভিযোগ তুলে কারো সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে কন্যাশিশুটি জ্ঞান হওয়ার পরে থেকেই জানে যে তার প্রতিদিনের জীবন আশেপাশের সব ছেলের তুলনায় কঠিন। এখানে সম্মান পেতে হলে অতিরিক্ত কিছু করে দেখাতে হবে। “ওভার এচিভার” হওয়া ছাড়া এই সমাজে মেয়েদের জন্য ন্যূনতম সম্মান বরাতে থাকবে না। সার্ভে করলে হয়তো দেখা যাবে, রাতদিন পড়াশোনা করা মেয়েগুলো কেবল পুরুষতন্ত্রের উপর ক্ষেপে গিয়েই পরীক্ষায় বাজিমাত করতে চাইতো।
তবুও বলতেই হয়, উদয়ন স্কুল কিংবা ভিকারুননিসা কলেজে বেশ নিরাপদ পরিবেশে ছিলাম। স্লাট শেইমিং কাকে বলে, কত প্রকার, কোনো মেয়ের মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখা গেলে তাকে নষ্ট করতে কিভাবে পুরো ব্যবস্থা একসাথে দাঁড়িয়ে যায়, সেটা বোঝা শুরু করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ঢোকার পর। এখানে কোনো মেয়ে বাইরে পড়তে যাচ্ছে, গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হলো ওর চরিত্র খারাপ। কোনো মেয়ে ভালো চাকরি পেয়েছে, কোনো মেয়ে হঠাৎ কিছুতে ভালো করেছে – বলে দাও, ওর তো চরিত্র খারাপ, তাই পেয়েছে। এই প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের মত স্লাট শেইমিংয়ের কারখানা বের করাই মুশকিল। কোনো পুরুষ শিক্ষকের রুমে পড়া বুঝতে গেলেও গুজব ছড়িয়ে যেত। আমি দেশের বাইরে আসার আগে রেকমেন্ডেশন লেটার চাইতে গিয়েও এই স্লাট শেইমিং দেখেছি। একটা সিস্টেম যে প্রতিনিয়ত নারী শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় “তুমি তো ঐ ঐ সব করে বেড়াও” বলে – আমরা প্রতিটি নারী যে সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠিনা, এটাই তো আশ্চর্য!
আরও অনেক কিছু বলা যায় – স্লাট শেইমিং থেকে এই জন্মে মুক্তি নেই বলেই মনে হচ্ছে। অবিবাহিত থাকায় এর উপর নানা রঙ এর নকশাও করা হয়। আবারো দ্বিধা সংকোচের সাথে বলি, এর বেশিটাই করেন আমার প্রাক্তন নারী সহপাঠীরা। তবে, পঁয়ত্রিশ পেরোনোর পর স্লাট শেইমিং এ বিরক্তি বা ঘৃণা লাগে, ভয় বা লজ্জা লাগে না। কিন্তু আজও মনে আছে কিভাবে শৈশব কৈশোরের অনেক দিন ভয়ে কুঁকড়ে কাটাতে হয়েছে!
ছেলে হলে জন্ম নিলে এই প্রতিদিনের ভয়ের জীবন যাপন করতে হতো না – নারীবাদ জানার বহু আগে কেবল স্লাট শেইমিং-ই এই কথা শিখিয়ে দিয়েছিল।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]