পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০১]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।।
১.
ফাঁকা ক্লাসঘরে ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটা হাঁটু ভাঁজ করে, কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে ঘুরে বাকলাই করে চলেছে। হলঘরের মতো বিশাল একটা নাচের ক্লাশ। বড় বড় কাঁচের জানালায় কাঠের ফ্রেম, ছিটকিনিঅলা। মেঝেতে ছাই রঙের উপর ছোট ছোট সাদাকালো মোজাইক। পুরনো আমলের দালান তাই এখনকার মতো থাই এলুমিনিয়াম স্লাইডিং গ্লাস বা টাইলসের মেঝে নয়। বাইরে তাকালে কটকটে রোদ আর ভ্যাপসা গরমটা বোঝা যায়। অথচ মেঝেটা শীতলপাটির মতো ঠান্ডা। মেঝেতে হাঁটু রেখে ঘরময় শিশুপার্কের বিরাটাকায় চায়ের পেয়ালার মতো ঘূর্ণি খেতে থাকে মেয়েটা। ঘষা লেগে হাঁটু ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছে তাও অনুভব করে।
স্বপ্ন আর ঘুমের ঘোরের মাঝামাঝিকে কী বলে? আধো ঘুম আধো জাগরণ? চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করে দোলন। জানালার পর্দা গলে ভাদ্র মাসের দুপুরের রোদ। রোদ একটু পড়ে এলে বারান্দার গাছগুলোতে জল দিতে হবে। ঢাকা শহরে কি কাকের সংখ্যা কমে গেছে?ছোটবেলায় কাকের ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যেতো। সকাল বিকেল ল্যাম্পপোস্টের তারে লম্বা সারি করে ওদের বসে থাকা দেখে দোলন ভাবতো, ওরা নিশ্চয়ই জরুরি সভা ডেকেছে। এতো সভা সমিতি করেও ওরা বুঝি টিকতে পারলো না এ শহরে! এই জঞ্জালের শহর থেকে গল্পের বই আর লেইসফিতার দুপুরের মতো কাকগুলোও কোথায় উড়ে পালিয়েছে! এই সব বেখেয়ালি কল্পনায় ভর করা দুপুরগুলোতে নিজের ঘরটাকে বড় আপন মনে হয় দোলনের। এই আধো ঘুম আধো জাগরণের অনুভূতি তার নতুন নয়। আগেও বহুবার স্বপ্নের মধ্যেই বাস্তবে ঘোরাঘুরি করেছে সে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই মনে হয়েছে আদি দুই হাত ভর্তি বাজার নিয়ে এসে ডোর বেল চেপে যাচ্ছে অথচ তার মোটেও ইচ্ছে করছে না ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে। আদি বিরক্ত হয়ে ফোন দিচ্ছে, দোলন ঘুমের মধ্যেই ভাবছে, ইশ্! ফোনের রিংগারটা অফ করে ঘুমানো উচিৎ ছিলো! এমন শান্তির ঘুম বাদ দিয়ে বাজার গোছানোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই। দুপুরের কটকটে রোদে ঘেমে-নেয়ে বাজারসদাই এনেছে বেচারা। কোথায় দোলনের মায়া হওয়া উচিৎ, তা না সে কিনা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! মাঝ বয়সে এসে আদির এই অতি সংসারী ভাব তার বিরক্ত লাগে। ঝাল – নুন – তেল আর আলু – পিঁয়াজের হিসেবনিকেশে প্রতিদিন দোলনের কত নতুন লেখার খেয়াল হারায় তার ইয়ত্তা নেই। রোজকার মতো আজো দোলন ভাবতে থাকে – নাহ্! আর এভাবে লেখালেখির আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই ঘুম ঘুম দুপুর, আধো জাগরণে তার ভাবনাগুলো শরতের মেঘের মতো ডানা মেলে দেয়। সেই মেঘের সাথে বুড়িছোঁয়া খেলায় মেতে ওঠে দোলন।
আদি অপেক্ষায় থাকুক! বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে দীর্ঘ একুশটা বছর এই সংসারে নিজের শ্রম, মেধা নিংড়ে দিয়েছে দোলন। শুরুর দিকে নিজেকে উজাড় করে ভালোবেসেছে সংসারটাকে। ভালোবাসার বিয়ে, প্রিয় মানুষকে নিয়ে অপরিণত সব ফ্যান্টাসিতে ভাসা আর কি! স্বেচ্ছায় ঘর বাঁধলেও আদি অল্প বয়সের চাঞ্চল্য ছাড়তে পারে নি, চায়ওনি খুব একটা। দোলনের প্রতিটি দিন বদলে গেছে, অবসর মেলেনি নিজের শরীর বা মনের যত্ন নেবার। একই ঘরে বসবাস করা আদি তার জীবন যাপন করে গেছে ফুরফুরে মেজাজে। আদির বিয়ে – সঙ্গী – সন্তানের জন্য প্রস্তুতি ছিল না – আশেপাশের মানুষের কাছে বিষয়টির মাহাত্ম্য অপরিসীম। অন্যদিকে দোলনের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও তা খেয়াল করার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ। বরং “পুরুষ মানুষকে ঘরে বেঁধে রাখার কৌশল” না জানার কারণে আশেপাশের মানুষের কাছে অযাচিত কথাবার্তা শুনতে হয়েছে। দোলন ভেবে কূল পায় না, “পুরুষ মানুষকে” ধরে বেঁধে কেন সংসারে মনোযোগী করে তুলতে হবে? সেই মনোযোগ পাওয়ার জন্যে ঠিক কী জাদুমন্ত্র বা স্ট্রিপ টিজ মেয়েদের জানা থাকতে হবে?
আদি বাজার হাতে নিয়ে আরেকটু অপেক্ষায় থাকুক! জগত সংসার অপেক্ষায় থাকুক!
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।