পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৪]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।
গভীর রাতে ইন্টারকমে ফোন বাজছে। রিমি বারান্দার চেয়ার ছেড়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে ফোনটা ধরে। মাঝরাত্তিরে ইন্টারকম বেজে ওঠা এ বাড়িতে নিত্যদিনের ঘটনা।
: হ্যালো!
: ম্যাডাম! আসসালামুওয়ালাইকুম!
ম্যাডাম! আপনি এট্টু নিচে আসলি ভালো হয়
: ওয়ালাইকুম সালাম সিরাজ! আমি আসতে পারব না। সেলিম নেই ওখানে?
: ম্যাডাম, স্যারে তো গাড়ির মদ্দি ঘুমোয় গিছে! উটোতে পারা যাচ্ছে না! ডেরাইভার আর আমি মিলে ম্যালাক্ষণ ধরে ডাকতিছি, স্যারে তো সাড়া দেয় না!
: সিরাজ, সেলিমকে বলেন আপনার কাছে চাবি দিয়ে চলে যেতে। স্যার গাড়িতেই থাকুক।
: জি ম্যাডাম! গাড়িতে থাকপে? কিরাম এট্টা মানসম্মানের ব্যাপার না? শেষে আবার কী দিয়ে কী হয়!
: কী দিয়ে কী হয় তা আপনার ভাবতে হবে না সিরাজ। উনি গাড়িতেই থাকুক!
কড়া গলায় কথাটা বলে ফোনটা ঠাস করে নামিয়ে রাখে রিমি। রাগে মাথাটা ঝা ঝা করছে।
সুজন এবারেও কথা রাখেনি। তার জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধও হবে না তার জানা কথা। বরং রিমি নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে লজ্জায়।
এই সিরাজের সামনে দিয়েই তিনবেলা বাড়িতে ঢুকতে হয়, বের হতে হয়। প্রায় রাতেই যে ড্রিংক করে বেসামাল হয়ে বাড়ি ফেরে সুজন, সকাল হলে রিমির অফিসে, বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে বের হতে গেলেই মনে হয়– বিল্ডিংয়ের সবাই জানে, এই বাচ্চা দুটোর বাবা রাতে মদ্যপ হয়ে ফেরে। গেটের সিকিউরিটি গার্ড সিরাজ, ড্রাইভার সেলিম, অন্যান্য ফ্ল্যাটের ড্রাইভার, ক্লিনার – এদের কাছে এইসব ব্যাপক বিনোদনের বিষয়। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের যে মনোকষ্ট – তাও যোগ হয়েছে রিমির নিজের কষ্টের বোঝার সাথে। এ ভার বহন করে চলা বড্ড ক্লান্তিকর। অথচ সকাল হলে সুজনের কিছুই মনে থাকবে না! দিব্যি বাড়ির কর্তা বনে যাবে। গত রাতের বমি করে ভাসানো বেডশিটের উৎকট গন্ধে তখনো বাড়িতে সবার অন্তত পরবর্তী সাতদিনের জন্য খাওয়ায় অরুচি ধরে যাবে, অথচ সুজন নির্বিকার চিত্তে ডাবল ডিম আর ঘিয়ে ভাজা পরাটার অর্ডার দিয়ে টিভির রিমোট টিপতে থাকবে যেন কিছুই হয়নি। পরপর হাতাহাতি, অশান্তির মাত্রা ছাড়িয়ে অবস্থা বেগতিক দেখলে কালেভদ্রে বলবে, “এতো রিএ্যাক্ট করার কী হলো? ক্লায়েন্টের সাথে এগুলো মেইনটেইন করে চলতেই হয়, খুব নরমাল একটা ব্যাপার। তাহলে কাজকর্ম ছেড়ে দেই, তোমার বেতনেই চলুক! রিমি! সিলি বিষয় নিয়ে ঝামেলা বাদ দাও তো! আচ্ছা আর খাচ্ছি না যাও, হ্যাপি নাও?” এটাই সুজনের সর্বোচ্চ ভদ্রোচিত বাতচিত।
রোজ অফিস থেকে ফিরেই শাওয়ারে চলে যায় রিমি। তারপর একটা কাপ কফি নিয়ে বসে ছেলেমেয়ের সারাদিনের জমে থাকা গল্প, নালিশ, টুকরো টুকরো কথা নিয়ে। মেয়ের চুলে বেণি বেঁধে দেয়া, ওদের হোমওয়ার্ক দেখে দেয়া, বাসার সাহায্যকারী ছুটা লোকের সাথে রোজকার কাজ-অনুপস্থিতির হার, বাজারঘাট নিয়ে প্যাঁচাল সেরে রাতের খাবার, পরের দিনের টিফিন-লাঞ্চবক্স নিয়ে রান্নাঘরে সময় দেয়া, ফোনে শাশুড়ীর সুগার-প্রেশার-বাতের ব্যথার খোঁজখবর নেয়া – সব শেষে আব্বার সাথে কথা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে আসতে চায়। একমাত্র এই মানুষটাই অপেক্ষায় থাকে রিমির ফোন আসার। লক্ষ কোটি মানুষের পৃথিবীতে একমাত্র আব্বাই ফোনটা ধরে বলে, “গলাটা ক্লান্ত কেন মা? কিছু খেয়েছো তুমি? আমার একটা কথা শোনো, এতো বেশি পরিশ্রম করতে যেয়ো না।”
আব্বার গলা শুনলে রিমির সব কান্না উপচে পড়তে চায়। আম্মার স্মৃতি এতো বছর পরেও পরিষ্কার মনে পড়ে রিমির। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং ক্লাস শেষে আব্বা, দাঁড়িয়ে ছিলো ঠায়। আব্বার মুখে রাজ্যের অন্ধকার নেমেছিলো সেদিন। রোজ দুপুরে আম্মা আসে, স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ারে কোনোদিন ঝিরিঝিরি করে চালকুমড়ো ভাজি আর দেশি মুরগির সাথে আলু দিয়ে লাল টকটকে ঝাল ঝোলে ভাত মেখে আনে, অন্য বাটিতে কাসুন্দিতে পেয়ারা মাখা নাহলে দুই টুকরো সরপুরিয়া মিষ্টি। কোনোদিন ডাবের পানি বোতলে ভরা থাকে, ছোট টিফিন বাক্সে ডাবের শাঁস। খিদের পেটে রিমির অমৃত মনে হয় আম্মার হাতের মাখা ভাতটুকু। সেদিন আব্বা খালি হাতে দাঁড়িয়েছিল,পাথরের মূর্তির মতো।
রিমি কাছে আসতেই থমথমে মুখে বলেছিলো, “নানুবাড়িতে যেতে হবে, তোমার মা…”
আম্মাকে না দেখে রিমির খুব রাগ হচ্ছিল। আম্মার কেন নানুবাড়িতে যেতে হলো আজকে? সকালেও তো বলেনি যে যাবে! আব্বাকে কেন পাঠিয়েছে আম্মা? আম্মা কেন আসেনি? নানুবাড়ি গিয়ে আম্মার সাথে একটা কথাও বলবে না সে।
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।