November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সম্মান আর প্রেম না থাকলে, সন্তান শুধু মায়েরই

আরাফাত লিও তন্ময় ।। পাবলিক ফিগার মাত্রই পাবলিকের সম্পত্তি নয়। আপনার ড্রয়িংরুমের গসিপ হওয়া ছাড়াও পাবলিক ফিগারদের একটা জীবন থাকে। সবার আগে এই বিষয়টা মাথায় রাখা দরকার। সবারই প্রাইভেট প্রাইভেসি বলে কিছু একটা থাকে, থাকা দরকার।

২০১ ‘তে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস যে দোলাচলে থেকে মিডিয়ায় সন্তানসমেত উপস্থিত হয়েছেন, এই ২০২২ সালে বুবলি একই ঘটনায় সন্তানের বাবা হিসেবে শাকিব খানকে ঘোষণা করলেন। তখন ‘বসগিরি’ সিনেমায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শাকিব খানের বিপরীতে বুবলির আগমনে অপু বিশ্বাসের ভয় হয়েছিল শাকিব তার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে কি না। সন্তানের পৈত্রিক পরিচয় – ভবিষ্যত নিয়ে তিনি শঙ্কিত ছিলেন। এখন শোনা যাচ্ছে শাকিবের বিপরীতে নায়িকার রোল প্লে করতে যাচ্ছে পূজা চেরি। শাকিবের সন্তানের মা এখন বুবলি। অপুর ফেজটা ভর করেছে বুবলির কাছেও – শাকিব ফসকে যাচ্ছে কী না! তাই সন্তানের পৈত্রিক পরিচয়ের স্বীকারোক্তি – ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্বীকার করা লেগেছে যে শেহজাদ খান বীর শাকিব-বুবলির সন্তান।

২০১৭’তে যে বিষয়টা চাউর হয়েছিল, আট বছরের সংসার জীবন কিংবা সন্তান জন্মের বিষয় কেন লুকায়িত ছিল, সময় পাল্টেছে দীর্ঘ পাঁচ বছর – এখনও সেই বিষয় উপস্থিত, গোপন রেখেছে কেন? আরে ভাই, কোনো দম্পতি তাদের বেডরুমের খবর শেয়ার করবে কি করবে না, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
অপু বিশ্বাস কিংবা শবনম বুবলি; তাদের যখন মনে হয়েছে সন্তান জন্মের বিষয়টা সবাইকে জানানোর দরকার, জানিয়েছে। এখানে তারা গোপন রেখেছে কেন সেটা নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া কেন?

এই দুই ঘটনায় একটা বিষয় খেয়াল করেছি, অপু বিশ্বাস যখন টেলিভিশন শো’তে এসে স্ত্রী-সন্তানের স্বীকৃতির জন্য কান্নাকাটি করলেন, প্রথমে কিন্তু শাকিব খান সেটা অস্বীকারই করলেন। তখন খবরের কাগজগুলোয় চোখ বুলালে খেয়াল করা যাবে, শাকিব বারবার বলছিল তার কেরিয়ার ধ্বংস করার জন্য কেউ অপু বিশ্বাসকে ব্যবহার করছে। অপু এত গুছিয়ে কথাই বলতে পারে না। শাকিবরা হয়ত এটা জানে না যে একজন নারী নিজের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কি ভীষণ শক্তিশালী হিসেবে পটভূমিতে অবতীর্ণ হতে পারে। উল্লেখ্য, ইরানে চলমান বাধ্যতামূলক হিজাব পরার বিরুদ্ধে নারীদের যে দুর্ধর্ষ আন্দোলন, এই নারীরাই কিন্তু গত চার দশক ধরে আইনটি মেনে আসছিলেন বা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন – মোরাল পুলিশ হেফাযতে মাহসা আমিনির নৃশংস মৃত্যুর পর নারীরা যখন খোলস ছেড়ে বেরিয়েছে; অনেক হয়েছে, তোমাদের জোরপূর্বক আনীত আইন অনুযায়ী আমাদের চুল আমরা ঢাকব না, তখন বোঝা গেছে নারীর ঐক্যবদ্ধ শক্তি দাবায়া রাখার সামর্থ্য স্বয়ং ঈশ্বরেরও নাই। প্রয়োজন শুধু নিজের অধিকার আদায়ের জন্য সময় মতো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা।

সন্তানের স্বীকৃতির জন্য অপু বিশ্বাসকে বলতে হয়েছিল, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি বিয়ের আগেই। নাম পরিবর্তন করে রেখেছি অপু ইসলাম। সিনেমার শুটিং সেটে সবাইকে লুকিয়ে রোজা রেখেছি, শাকিব সাহায্য করেছে।
প্রেমের সময় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাত্রী নির্বাচনে ছেলেদের সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় বিয়ের সময়। মেয়েরাও ভাবে, আমার ভালোবাসার মানুষ। মানুষটাকে নিজের কাছে রাখতে বিসর্জন দেয় স্বধর্মেরও। হে নারী, যে পুরুষ ভালোবাসার জন্য ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে আপনার সঙ্গে থাকতে পারে না, ধর্ম পরিবর্তন-পরবর্তী সে আপনার প্রাপ্য সম্মান ভালোবাসা দেবে সেই ভরসা কোথায় পান? তখন আপনি তার কাছে হয়ে যাবেন টেকেন ফর গ্রান্টেড। স্বধর্ম ত্যাগে নিজের মানুষদের কাছে হবেন ব্রাত্য, ধর্মান্তরিত আপনাকে নতুন মানুষেরা দেখবে আড়চোখে। আপনার অপশন তখন শূণ্য।

ধর্মান্তরের বিষয়টা সামনে না এনে অপু বিশ্বাসের হাতে অবশ্য অপশন ছিল না। তখন বাংলার নেটাগরিকদের মনে হয়েছে একজন মোসলমান নারীর প্রতি এমন অবহেলা তারা মানবে না। এর বাইরে দেশের কথিত নাম্বার ওয়ান সুপারস্টারের কাছ থেকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হতো না। সে যাত্রায় অপু বিশ্বাসের ধর্ম নামের ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার তাকে এনে দিয়েছিল স্ত্রীর স্বীকৃতি (পরে যদিও এক কোটি টাকার বিনিময় ডিভোর্স সম্পন্ন হয়েছে) তার ছেলে পেয়েছে এক জীবনের জন্য শাকিবপুত্রের স্বীকৃতি।

বুবলিকে সেসব কিছুই করতে হয়নি। কাঁদতে হয়নি মিডিয়ার সামনে এসে। অন্তত আমাদের দেখা লাগেনি আরকি। প্রথমে অস্বীকার করেনি শাকিব খানও। তবে ধর্ম নামের ট্রাম্পকার্ড ব্যবহারে বুবলিও পিছিয়ে থাকেনি। সন্তানজন্মের স্বীকারোক্তির আগে ঠিকই বলেছে, “সবকিছু ধর্মীয় অনুশাসন এবং শালীনভাবেই হয়েছে।”

শাকিব খান নিজেকে বলিউড কিং শাহরুখ খানের ফ্যান হিসেবে প্রকাশ করতে চায় – সিনেমার নাম, বাড়ির নাম এমনকি সন্তানের নামে পর্যন্ত প্রায় অনুকরণ করে। একটা জায়গায় এসে তার বাঙালি মোসলমান সত্তা জেগে ওঠে – অন্য ধর্মের নারীকে স্ত্রী স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে। শাহরুখ-গৌরি দীর্ঘদিন সুখের সংসার (অন্তত আমরা যা দেখছি) করতে পারলেও চিরায়ত বাঙলি মোসলমান শাকিব খান ভালোবাসা ধরে রাখতে পারেনি ধর্মান্তর করে মোসলমান বানিয়ে নেয়া অপু বিশ্বাসের প্রতি। ফাঁকতালে ভালোবাসার নামে ধর্মান্তর করে এক নারীকে আরও অসহায় করেছে।

অপু বিশ্বাস-বুবলির কাছে সুযোগ ছিল চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক রাজা শাকিব খানকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলবার। অপু প্রতিষ্ঠিত নায়িকা, বুবলিও জায়গা করেছে নিয়েছে – সন্তান লালনের জন্য পৈত্রিক পরিচয় এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? অপুকে তো ডিভোর্স দিয়েছে আগেই, অপু বিশ্বাস কি এখন সন্তানকে বড় করছেন না? একই ঘটনা ঘটতে পারে বুবলির বেলায়ও। তখন সে সন্তানকে বড় করবে না? মুহূর্তের আনন্দে দু’ফোঁটা বীর্য ফেলে যে নির্লজ্জ পুরুষ উধাও হয়েছে, যাবতীয় কষ্ট নিজে সয়ে দশ মাসের গর্ভধারিণী নারী তবুও কেন কেবল নিজের পরিচয়ে সন্তানকে বড় করতে ভয় পায়? সর্বোপরি, ক্লান্তিকর এই দীর্ঘ ভ্রমণটা তো নারীর একার।

কলকাতার নুসরাত জাহান পারেনি, অপু বিশ্বাস বা শবনম বুবলি সেই কাজটা করতে পারবে ভাবনাটা দুঃসাহসিকই বটে। তবে আশায় বাঁচে জীবন। যে পুরুষ পদে পদে অসম্মান করে, প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না, দেয় না ফিরতি ভালোবাসাও – তাকে পুজো দেয়ার কোনো মানে হয় না।

তাই অপু বিশ্বাস, বুবলিদের বলি পুরুষতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক না হয়ে সম্পর্কে সম্মান-মর্যাদা-ভালোবাসার ন্যূনতম অবশিষ্ট না থাকলে সন্তানকে বড় করুন কেবল মায়ের পরিচয়েই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *