December 23, 2024
সাহিত্যউপন্যাস

পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৭]

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।

খালার বকবকানি শুনে এই সুন্দর সকালের আমেজটা ভেস্তে দেবার কোনো মানে হয় না। খালি বাড়িতে দোলনের বেশ শান্তি শান্তি লাগে। তাছাড়া প্রতিবার বাড়ি গেলে নাজমা খালা নতুন গল্প ফাঁদে। ফোন দিলে নির্ঘাত অন্য কেউ ফোনটা তুলবে যার কথাবার্তার আগামাথা প্রায় কিছুই বোঝা যাবে না। এরপর বলতে থাকবে, হ্যার মাইয়ার “জোন্ডিশ” (!) ডাক্তরে কইসে “কিটনি” নষ্ট (!)…  হ্যায় মাইয়ারে লই কবিরাজের বাড়িত গেছে ঝাড়াইতাম।…

সংসারের বয়স কম হলো না। দোলনের সব মুখস্থ  হয়ে গেছে। ঘর মোছার মেয়েটা খুব সকালে আসে। পাঁচ বাড়িতে কাজ করে মাসে হাজার পনের টাকা আয় করে। চকচকে চোখের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির নাম রানী। “তোমার নাম রানী কে রেখেছিল?” – জিজ্ঞেস করলে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। ঘর মোছা থামিয়ে বলে, “শুনিছি, মায়ে রাখিছিল!”

দোলন কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবতে থাকে, দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয়া সমাজের কাছে “কালো” মেয়েটা তার মায়ের কাছে রানীর মতো! নিশ্চয়ই চেয়েছিল, রানীর মতো রাজকীয় জীবন হবে তার মেয়ের! সাত’শ দাসীর সেবায় সোনার পালংকে গা এলিয়ে, হীরে-জহরতে মোড়া থাকবে মেয়ে…।

“রানী তো আর হইনি,  হলাম গিয়ে বান্দি!”– রানীর কথাটা কানে এসে লাগে।

দোলন এবার নড়েচড়ে বসে, “শোন! রানীদের জীবন আরামের ছিল না বুঝলে! কোনো স্বাধীনতা ছিল না। রাজাদের পয়সায় আরাম-আয়েশ যেমন করতো, তাদের কথায় উঠতে-বসতে হতো। নাহলে তাদেরও গর্দান যেতো। এই যে, তুমি স্বাধীনমতো কাজ কর, নিজের মতো আয় কর – সেই দিক থেকে চিন্তা করলে এটাই রানীর জীবন, ঠিক না?”

রানী ঘর মোছে আর হাসতে হাসতে গড়ায়, “আপা যে কী কন না কন! আপনার কতা শুনলি আমার মোটে হাইস আইলো! হাসতি হাসতি মুত এসে গিইলো।

দোলন গম্ভীর মুখে বলে, “এসব আবার কী কথা? তুমি কাজ সেরে যাও তাড়াতাড়ি, আমি বের হব।”

বাড়িতে কিছুটা সময় একা থাকতে মন্দ লাগে না। একটা রিসোর্ট রিসোর্ট অনুভূতি হয়। তবে যতটা পড়ালেখায় সময় দিতে চায়, ততোটা হয়ে ওঠে না। দোলনের এখন ইচ্ছে হয় পৃথিবীটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে দু’হাতে লেখালেখি করতে। লেখার টেবিলের মতো আপন আর কোনোকিছুকেই মনে হয় না। লেখা দিয়ে সে বিশ্বজয় করে ফেলবে তাও না, তবু এইটুকুই তার নিজস্ব পরিচয়। কর্পোরেট অফিসে পনেরো বছরের চাকরিজীবন এই নিজস্বতাটুকু কেড়ে নিয়েছিল। লেখালেখি থেকে সে ছিটকে গিয়েছিল বহুদূর। কর্পোরেট কালচারের সাথে কখনো মানসিকভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি দোলন। না ড্রেসকোড, না রোবোটিক পরিবেশ। মেয়েদের হাই হিল, বন্ধ জুতো, এই গরমের দেশে নয়টা-পাঁচটা ছেলেদের স্যুট-টাই পরে হাসফাঁস করে অফিস করাটা রীতিমতো অবাস্তব মনে হয় তার। উপরে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে এর ওর ঘাড়ে পা দিয়ে ছোটাছুটিও ভালো লাগাতে পারেনি কোনোদিন। যারা পারে, তারা পারে। সফলতার জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরার চেয়ে নিজের ভালোলাগা পথে ধীর পায়ে এগোতে দোলনের বেশ লাগে। সিদ্ধান্ত নিতে কখনো অন্যের দ্বারস্থ হয়নি সে। দাপ্তরিক কাজে আদিরও দোলনের পরামর্শ দরকার হয় প্রায়শই।

কবে, কখন দোলন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে তার হিসেব সে রাখেনি। তবে এভাবে যে চলতে দেয়া যায় না – সেটা সে যখন থেকে উপলব্ধি করেছে, আদির অপেক্ষায় সে বসে থাকেনি। নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে। এতো বছর পেরিয়ে আদি এখন নিজের অনুতাপের কথা স্বীকার করে। নিজের ছোটখাটো অফিস হয়েছে। ঘন ঘন ট্যুরে যাওয়া দূরের কথা, খুব প্রয়োজনের ট্যুরগুলোতে গেলেও মিস করে দোলন আর বাচ্চাদের। মাঝেমধ্যে আবেগঘন হয়ে আদি বলেই ফেলে,

“দোলন, চলো আমরা আরেকটা বাচ্চা নেই!”

দোলন হেসে উড়িয়ে দেয় – “কেন বাচ্চারা বড় হয়ে সবে হাত-পা ঝাড়া হয়েছি, তোমার বুঝি আমার জানের আরাম সহ্য হচ্ছে না?”

আদি কাছে এসে দোলনের গালে ঝুল খেতে থাকা চুলের গোছা সরিয়ে দিতে দিতে বলে, “বিশ্বাস করো, এবারে তোমার কোনো কষ্ট হতে দেবো না! তোমার যত্ন, বাচ্চার যত্ন, সব আমিই করবো। তখন তো আসলে বুঝিনি, কত কিছু করার ছিল আমার!”

আদি এখন যা বলে, মন থেকেই বলে। সত্য অনুভূতিটা ওর চোখ দেখেই পড়তে পারে দোলন, আদির নিঃশ্বাসের শব্দে প্রেমের আশ্বাস অনুভূত হয় প্রবলভাবে। গভীর চাহনি বলে, “প্রেমে জল হয়ে যাও গলে”।

আদির প্রতি প্রেম তো আছেই। তবু বেশি ভালোবাসায় দোলনের এখন ভয় হয়।

কফি শেষ করে দ্রুত উঠে পড়তে হবে। এগারোটা নাগাদ মিটিং আছে। দুটো ডকুমেন্টারির স্ক্রিপ্ট তার হাতে। তার মধ্যে একটা বেবি ব্লুজ বা মেটারনিটি ব্লুজ নিয়ে। এই স্ক্রিপ্টটা লিখতে গিয়ে সেই দিনগুলোর কথা বারবার ভেসে উঠেছে সামনে। আদির কেয়ারিং হয়ে ওঠাতে ঘরে স্বস্তি এসেছে সত্য কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরে আসেনি। আবেগে ভেসে যাবার সময়গুলো দোলন কোথা দিয়ে যেন পার হয়ে এসেছে।

[চলবে]

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের  টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *