নারী যখন কর্মক্ষেত্রে
ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। কন্যাসন্তান যদি কৃতি হয়, তাহলে সেও হয়ে উঠতে পারে বাবা-মার বার্ধক্যকালীন সহায়। বার্ধক্যকালীন সহায়তার কথা ছাড়াও যে প্রশ্নটি বারবার উত্থিত হয়, নারীর আয় তার বাপের বাড়িকে কতখানি স্বাচ্ছন্দ্য দেয় যা তাকে পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। আমরা সাধারণত কৃতি মেয়েদের উদাহরণ টানি, যে কৃতিত্বের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অজস্র নারীর শ্রম যাপন যেমন নারী বিজ্ঞানী, নারী পাইলট, বিশিষ্ট নারী সমাজকর্মী ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশিষ্টতার ভূষণ ধারণ না করা পর্যন্ত নারীর শ্রম মূল্যবান হয় না। আমাদের উপমহাদেশে বেকার বেশি শিক্ষিত মহিলাদের তুলনায় নিরক্ষর কিংবা স্বল্প স্বাক্ষর মেয়েদের আয় তাদের সংসারে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ব্যবহারিক জীবনে এই অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষরদের দৈহিক শ্রমের ক্ষেত্রটি বেশি প্রসারিত।
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো থেকে যারা বিজ্ঞান প্রযুক্তি শাখায় যাচ্ছেন তারা সংখ্যায় নেহাৎ মন্দ নয়, কিন্তু তাদের যোগ্যতা বেশিরভাগ সময়ই সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্র পাবার আশায়। এদের কেউ কেউ চাকরি জীবনে প্রবেশও করছেন কিন্তু বিয়ের পর কিংবা বাচ্ছা হবার পর তারা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। কোনো কোনো সময় এটাও হচ্ছে যে তারা তাদের প্রযুক্তির পরিসর থেকে বেরিয়ে নিম্ন আয়ের স্বল্প সময়ের কোনো ক্ষেত্রে কাজ নিচ্ছেন। তাদের পরিবারে সেই আয়ের গুরুত্ব খানিকটা শৌখিনতার পর্যায়েও পড়ে।
মধ্যবিত্ত বাঙালি মূল্যবোধের ক্রমবিবর্তনের ফলেই আজকের বিপুলসংখ্যক নারী বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষার প্রাঙ্গনে। সেটা আমাদের গরিমা কিন্তু গৌরব নয়। যে সমাজ নারীকে শক্তি হিসেবে মেনে নিতে সক্ষম হয়েছে সেখানেই তাকে উপার্জনে সহায়তা করা হয়। নিম্নবিত্তের কাছে এটি বাধ্যতাও বটে। কিন্তু সেই সমাজেও যখন নারীটির পুত্রসন্তান কর্মপোজীবী হয় এবং সাংসারিক হাল ধরতে পারঙ্গম হয়, তাহলে নারীর আয়ের গুরুত্ব আবার কমে আসে, কারণ উচ্চ আয়সম্পন্ন পরিবার সামাজিক সম্মান রক্ষার তাগিদে চায় না তাদের মা বোন কোনোপ্রকার শ্রম বিক্রি করুন।
এবার আসি তাদের প্রসঙ্গে যারা বিয়ে, মাতৃত্ব, সন্তান পালন, পারিবারিক বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজেকে শ্রমের বাজারে জিইয়ে রেখেছেন। একজন পুরুষকে এই একই আয়ে শ্রমের বাজারে যে পরিশ্রম করতে হয় নারীর শ্রম পরোক্ষভাবে সেখানে অনেক বেশি। পারিবারিক তথা সামাজিক শ্রমবিভাজনের বিবর্তনে উপমহাদেশের নারীদের আয়ের গুরুত্ব তাই উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। উল্টোদিকে বিভিন্ন সমীক্ষায় এও দেখা গেছে যে, বিবাহ ক্ষেত্রে রোজগেরে কন্যা তার চেয়ে বেশি রোজগেরে বর পছন্দ করে। ফলে ভবিষ্যতে মেয়েটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে।
আশার কথা এই যে, লেখাপড়ায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং সরকার স্কুলছুট কমাতে নানান ভাতার বন্দোবস্ত করছেন। কিন্তু নারীর কর্মক্ষেত্র যাপনের পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাঁকে পরিবারে অফিসে নিজেকে নিঃশেষিত করতে করতে জীবনকে আরো লড়াইয়ের ময়দানে ঠেলে দিতে হচ্ছে, যেন লেখাপড়া শিখে কাজ করতে আসাই তার অপরাধ। এ ব্যর্থতা অতিক্রম করতে হবে নারীকেই, সামাজিক শ্রমবিভাজনের চিরায়ত ধারণাগুলির বিপরীতে হেঁটে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]