সারাহ বার্টম্যান: যে নারীর শরীর ছিল শ্বেতাঙ্গ ‘সভ্য’দের দেখার বস্তু
পূরবী চৌধুরী ।। মাত্র ২৬ বছর আয়ুর সারাহ বার্ট্ম্যান সেই শিশু সময় থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পার করেছেন এক মানবেতর এবং অস্বাভাবিক জীবন। দাসত্বের পাশাপাশি তাঁর নারী শরীরের নানা অমানবিক ব্যবহার করা হয়েছিল এমনকি তাঁকে পশুর চাইতেও খারাপ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত পশ্চিমীরা। ফ্রান্সে প্রদর্শনীর সময় কষ্টে ভারাক্রান্ত সারাহ ব্রাটম্যান নিজের পরিচয় এভাবে তুলে ধরতেন-
“আই এম সারাহ, ভেরি আনহ্যাপি সারাহ”।(আমি সারাহ, চরম অসুখি সারাহ)
ধারণা করা হয় সারাহ হলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যাকে ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং অবর্ণনীয় প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন তিনি। সারাহ’র জীবনে না ছিল মর্যাদা, না ছিল গোপনীয়তা, এমনকি নিজের নাম ও পরিচয় বদল হয়েছে নানা পরিস্থিতিতে। আফ্রিকান নারী হিসেবে বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়া ছাড়াও জীবনের প্রতি পদক্ষেপে অবমূল্যায়িত হয়েছিলেন সারাহ বার্টম্যান। সারাহ বার্টম্যানের জন্য অবমূল্যায়ন শব্দটা ঠিক যথেষ্ঠ নয়, তাঁর জীবনের মর্মান্তিক এবং নৃশংস ঘটনাগুলো এ শব্দটাকে হার মানায়। শুধু যৌনকাজে ব্যবহার করা ছাড়াও আরো নানা পন্থায় বিকৃতভাবে তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছিল যা বর্ণনাতীত।
আটারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শুরুর দিকের মাত্র দুই যুগের ঘটনা এটি, দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশরা তখন ঔপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। আফ্রিকার “খইখই” নামক আদিবাসী যা ইংরেজিতে “হটেনটট” নামেও পরিচিত এবং এই আদিবাসীদের একজন হলেন সারাহ বারর্ট্ম্যান। জন্মেছিলেন ১৭৮৯ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব দিকের অংশে গ্যামটুস নদীর কাছে। সারাহর পরিবার ব্রিটিশদের যে খামারবাড়িতে পরিচারক হিসেবে কাজ করতেন, সেখানেই সারাহ ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠেন। কঠিন জীবন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে কেটেছে তাঁর ছোটবেলা। সারাহর মাত্র দু’বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান এবং কিশোরী বয়সে বাবাকেও হারান তিনি। সারাহ’র বাবাকে বুশম্যানরা মেরে ফেলেছিল। “খইখই” আদিবাসীদের একজনের সাথে সারার বিয়ে হয়, তিনি নাট্যকলার সাথে যুক্ত ছিলেন, সম্ভবত বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। বিয়ের পর এক সন্তানের জন্ম দিলেও সেই সন্তান জন্মের পরই মারা যায়। তারপরেই তাঁর স্বামীকেও হত্যা করা হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
সেই সময় পুরো আফ্রিকা ব্রিটিশদের দখলে ছিল এবং পরিবার-পরিজনহীন সারাহকে বিক্রি করে দেয়া হয় পিটার উইলিয়াম সিজার নামে এক ডাচ ব্যবসায়ীর কাছে। সে সময় দাস হিসেবে বিক্রি হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বেঁচে থাকা নির্ভর করতো এসব মালিকদের চাওয়া না চাওয়ার উপর। বিক্রি হবার পর সারাহকে অনেকটা জোর করেই তাঁদের গ্রাম ছেড়ে কেপটাউনে চলে আসতে বাধ্য করা হয় এবং সেখানে সিজারের ভাই হেন্ড্রিকের পরিচারিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এখানে তাঁর নাম পরিবর্তন করে ডাচদের সাথে মিল রেখে সারজিন রাখা হয়। এই পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দাস হিসেবে সারাহর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব যেন তাদের হাতে থাকে। কেপটাউনে অন্যান্য দাসদের মতোন সারাহ খুব মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন। এই সময় তিনি পরিচারিকা এবং ওয়েট নার্স অর্থাৎ নবজাতকদের স্তন্য পান করানোর কাজ করতেন। দীর্ঘদিন এই কাজ করার পর সারাহর সাথে পরিচয় হয় স্কটিশ মিলিটারি সার্জন ডানলপের সাথে, যিনি তার চিকিৎসক হিসেবে পেশার পাশাপাশি ব্রিটেনে প্রদর্শনের জন্য বিরল প্রজাতির প্রাণিদের সরবরাহ করতেন। ডানলপ সারাহকে বেশি টাকা উপার্জনের কথা বলে ব্রিটেনে সার্কাসে তাঁর শরীর প্রদর্শনের প্রস্তাব দিলেন।
তখন সারাহর বয়স মাত্র একুশ বছর, ১৮১০ সালের ২৯শে অক্টোবর উইলিয়াম ডানলপ এবং সিজার ও তার ভাই উভয়ের যৌথ অংশীদারিত্বের শর্তে সারাহ তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন এবং অলিপিবদ্ধ কিন্তু নতুন মোড়কে বিক্রি হলেন সারাহ। শিক্ষা না থাকা এবং ভাষা না জানার কারণে সারাহ এই চুক্তির আদ্যপান্ত না পড়েই এতে সাক্ষর করেন। চুক্তিটিতে বেশ ছলচাতুরী করা হয়েছিল, সারাহ’র বোঝার বাইরে ছিল এবং চুক্তিটির কোনো কপি সারাহর কাছে ছিলনা। কারণ সেই সময় ব্রিটেনে দাসপ্রথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যৌথচুক্তিতে উল্লেখ ছিল, সিজার ও ডানলপের পরিচারিকা হিসেবে তারা যেসব জায়গায় ভ্রমণ করবে সেখানে তাদের সাথে সারাহ যাবেন এবং তারা চাইলে সারাহকে বিনোদনের জন্য জনসমক্ষে প্রদর্শন করতে পারবেন। এই প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত আয়ের অংশ সারাহও পাবেন এবং পাঁচ বছর পর চাইলে সারাহ তাঁর নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরত যেতে পারবেন। যদিও এই চুক্তির কিছুই মানা হয়নি, সারাহ প্রতারিত হয়েছিলেন প্রতি পদক্ষেপে।
পিকাডেলি নামক এক সার্কাস পার্টির সাথে চুক্তি করেন সিজার এবং ডানলপ, ১৮১০ সালের ২৪ নভেম্বর প্রথম জনসমক্ষে সারাহ’র শরীরের প্রদর্শনী হয় লন্ডনে, উল্লেখ্য যে এখানে সারাহ সম্পর্কে প্রদর্শনীতে মূলত তার শরীরের বিশেষ অংশ যেমন নিতম্বের কথা উল্লেখ করেই প্রচারণা চালানো হয় দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য। সারাহ “হটেনটট ভেনাস” নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তবে ভেনাস শব্দটির অর্থ সারাহকে মূল্যায়নে বিপরীতভাবে ব্যবহার করা হত। সারাহ’র শারীরিক গঠন নানাভাবে বর্ণিত হয় নানা জায়গায় – কেউ বলেন কদাকার, কেউ বলেন ভালো তো কেউ খারাপ। তবে সারাহ’র শারীরিক গঠন বিপরীত সেক্সের মানুষকে আকৃষ্ট করতো, পশ্চিমা পুরুষরা এটা নিয়ে একটা ফ্যান্টাসির মধ্যে থাকতো, এর ফলস্বরূপ এরা এই মানুষদের নানা হয়রানিসহ বিকৃত যৌন প্রবৃত্তি মেটানোর চেষ্টা করতো। সারা বার্টম্যানের শারীরিক গঠনের নাম স্টিটোপিজিয়া যা একধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্য যা “খই খই” আদিবাসী নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
সারাহকে সার্কাসে প্রদর্শনের সময় খুব খোলামেলা পোশাক পরানো হতো, নারী-পুরুষ সমানভাবে তাঁকে দেখতে আসতো। একটু বেশি টাকা দিলে দর্শকরা সারাহকে ছুঁতে এবং খোঁচাতে পারতো। তবে এই ছুঁয়ে দেখা স্বাভাবিক ছিল না, যা অত্যন্ত বিকৃত যৌন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ছিল। সারাহকে দেখতে অনেক নারীরাও ভিড় জমাতেন কারণ তারা এটা দেখতে আসতেন যে সারাহর শারীরিক গঠনে এমন কি আছে যে পুরুষরা সারাহকে নিয়ে এত আগ্রহী। কিছু মানুষ সারাহকে অস্বাভাবিক দানবিক এবং কিছুটা পশুর শরীরের সাথেও তুলনা করতেন এবং এই কারণেও দেখার আগ্রহ প্রকাশ করতেন। সেই সময় সারাহ বার্টম্যান এক অর্থে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর শারীরিক গঠন নারীদের বেশ আগ্রহান্বিত করেছিল এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে ফ্যাশনেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। নারীরা সারাহর মতো উঁচু নিতম্ব বানানোর উদ্দেশ্যে নিতম্বের দিকে প্যাড ব্যবহার করে পোশাক বানানো শুরু করে। সারাহ অস্বাভাবিকভাবে শরীরে হাত দেয়া প্রত্যাখান করতে চাইলে তাঁকে সার্কাসেই জনসম্মুখে চাবুকের মাধ্যমে হুমকি দেয়া হয়েছিল। যেহেতু সারাহর কেউ ছিল না, তাই তাঁর এসব সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলনা।
বিষয়টি দাসপ্রথা বিলুপ্তি আন্দোলনে সংশ্লিষ্ঠজনদের চোখে পড়লো, তারা আফ্রিকান অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েছিল সারাহ কতটা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর ফলশ্রুতিতে সিজার এবং ডানলপের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হলে তারা কোর্টে সারাহর সাথে তাদের চুক্তিপত্রটি দেখান এবং সারাহও তাদের পক্ষেই সাক্ষী দেন। ফলে এই শো আরো জনপ্রিয় হয়ে যায়, এবং ইংল্যান্ড থেকে দূরদূরান্তে শো চলতে থাকে আয়ারল্যান্ড পর্যন্ত। তবে সবার মনে এই প্রশ্নটাও জাগে যে সারাহ এমন সুযোগ পেয়েও কেন মুক্ত হলো না, তার পেছনের কারণ হিসেবে মনে করা হয় সারাহকে হুমকি দিয়েছিল কিংবা নতুন কোনো প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই সারাহ তার জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে, মানুষও এই শো থেকে আগ্রহ হারায়। ফলে চার বছর ইংল্যান্ডে থাকার পর প্যারিসের শোন রু নামের একজন পশু প্রশিক্ষকের কাছে সারাহ আবার বিক্রি হন, যিনি তাকে প্যারিসে নিয়ে যান। এটি তাঁর জীবনের দ্বিতীয়ধাপের অবমূল্যায়ন যেখানে সে যে সার্কাস শোতে অংশ নিতেন কখনো কখনো তাকে খাঁচায় রেখে পশুদের সমতূল্য করে প্রদর্শন করা হতো এবং তাকে পশুদের অঙ্গভঙ্গি করতে হতো দর্শককে আনন্দ দেবার জন্য। এর পাশাপশি তাকে অমানবিকভাবে পতিতাবৃত্তি করতে হতো এবং সেটা একই সময়ে অসংখ্য বন্য এবং মাতাল পুরুষদের জন্য। শোন রু এখানে অনেক টাকা উপার্জন করলেও সারাহকে কোন টাকাই দিত না। সারাহর মালিকরা দিনদিন টাকা পয়সায় ফুলেফেপে উঠলেও সারাহকে ঠকিয়েছে প্রতি ক্ষেত্রে। সারাহ এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষের হাতে বিক্রি হয়ে গরীবই রয়ে গিয়েছিলেন। নানান মানসিক অত্যাচার সহ্য করে অমানবিক পরিশ্রম করে গেছেন, কিন্তু এতে নিজের ঝুলিতে টাকা নয় জমেছিল নানান শারীরিক অসুস্থতা। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ২৯শে ডিসেম্বর ১৮১৫ সালে তিনি মারা যান। যেহেতু তার মৃত্যুর কারণ পরীক্ষা করে জানা হয় নি তাই ধারণা করা হয় সিফিলিস বা নিউমোনিয়া বা অতিরিক্ত অ্যালকোহল নেয়া বা স্মলপক্সে তিনি মারা গিয়েছিলেন। নিজের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, অবহেলিত দরিদ্র অবস্থায় মৃত্যু হলো সারাহ বার্টম্যানের।
হায়রে সারাহ, মারা যাবার পরও রেহাই পেলেন না এই বর্বর অমানুষদের কাছ থেকে। ফরাসী বিজ্ঞানী যিনি জীবিত অবস্থায় সারাহর শরীরের বিভিন্ন অংশের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, মৃত্যুর পর সারাহর শরীরের ব্যবচ্ছেদ করার অনুমিত পেলেন। আরো দুঃখজনক হলো এই ব্যবচ্ছেদ তাঁর অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ছিল না, বরং তাঁর যৌনাঙ্গ দেখতে কেমন ছিল তা জানার আগ্রহ ছিল বহু মানুষের। সারাহর শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন মস্তিষ্ক, যৌনাঙ্গ, কংকাল প্রদর্শনীর জন্য সংরক্ষিত ছিল প্রায় ১৫০ বছর। ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার অনুরোধে সারা বার্টম্যানের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও এটি করতেও প্রায় আট বছর আইনি লড়াই লড়তে হয়েছিল, বিভিন্ন সামাজিক ক্যাম্পেইনের মুখে ফ্রান্স তাঁকে ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ২০০২ সালে সারাহ বারর্ট্ম্যানকে তার দেশে সমাধিস্থ করা হয়। দেশ থেকে বের হয়েছিলেন একটু সুস্থ জীবনের আশায়, খুঁটি গেড়েছিলেন সভ্য মানুষদের আস্তানায়, কিন্তু শিকার হলেন সর্বাধিক অবমাননার, বর্বরতার। তারপর প্রায় দুইশো বছর পর ফিরলো তাঁর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীর নিজের দেশের মাটিতে, শান্তির ঘুম ঘুমাতে।