ভাস্কর শামীম শিকদার: নিজের শর্তে যাপন করলেন যে জীবন
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। গতকাল রাতে যখন টেলিভিশনে শামীম শিকদারের মৃত্যুর খবর জানাচ্ছিল তখন আমার প্রথম যে কথাটা মনে এসেছিল, আরে, শামীম শিকদার কবে দেশে ফিরলেন? ২০০০ সনে তিনি একুশে পদক পেলেন আর ২০০১ সনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই তিনি দেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন। স্বামী সন্তান নিয়ে বাস করতেন লন্ডনে – লন্ডনেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন, এর মধ্যে আর তিনি দেশে ফেরেননি। হয়তো এসেছিলেন মাঝে কোনো সময়, আমরা কেউ জানতাম না। তবে কি আমাদের এই দুরন্ত ভাস্কর কেবল দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন বলেই এবার ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন!
শামীম শিকদারের জন্ম ১৯৫৩ সনে। ভাস্কর্য পড়েছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে ও লন্ডনে। ১৯৭৪ সনে বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে তাঁর শিল্পকর্মের জন্যে ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকার একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিয়েছিল। ১৯৮০ সন থেকে শিক্ষকতা করেছেন, চারুকলায় অধ্যাপক হয়েছিলেন ১৯৯৯ সনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁর স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এই দুইটা ভাস্কর্য অধিক পরিচিত, এছাড়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে। তবে কেবল ভাস্কর্যের জন্যে তিনি দেশব্যাপী পরিচিত ছিলেন না, দেশব্যাপী তাঁর পরিচিতির একটা অংশ ছিল তাঁর লাইফস্টাইল, পোশাক আশাক এইসবের জন্যে। সবসময় প্যান্ট শার্ট পরতেন, সাইকেল করে ঘুরে বেড়াতেন বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশে সর্বত্র। তিনি সাথে অস্ত্র রাখতেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। তাঁর দৃঢ় ও উচ্চস্বরে কথা বলা, প্রয়োজনে লোকজনকে ধমক টমক দেওয়া এবং প্রথাগতভাবে ‘মেয়েলী’ নয় এরকম ভাষা ব্যবহার – এইসবের সঙ্গে সাথে অস্ত্র রাখার ব্যাপারটা বেশ মানিয়ে যায়। শামীম শিকদারকে নিয়ে সেসময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল, সেখানেও ওর শিল্পকর্মের চেয়েও এইসব বৈশিষ্ট্যই বেশি আলোচিত হয়েছে।
যখনই বাংলাদেশে ভাস্কর্য প্রসঙ্গে আলোচনা হয়, নারী ভাস্কর প্রসঙ্গ হলে তো অবশ্যই, তখনই নভেরার নাম আলোচনায় আসে। নভেরা আর শামীম শিকদার এই দুইজন কাছাকাছি সময়ের হলেও দুইজনের মধ্যে খুব বেশি মিল নেই। কেবল একটা জায়গায় মিল, সেটা হচ্ছে যে দুইজনই আমাদের প্রচলিত সমাজ নারীর জন্যে যে রূপ, আচরণ ও জীবনবিধান নির্ধারিত করে রেখেছে সেটাকে অস্বীকার করেছেন। দুইজনই বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজের শর্তে নিজের মতো করে, নিজের শিল্পকর্মের মধ্যে। নভেরা বৈরিতার মোকাবেলা করেছেন বেশি, অভিমানী ছিলেন, নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। নভেরা যখন আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করতে চেয়েছিলেন তখন তাঁকে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়নি। না, নভেরাকে ওরা অযোগ্য মনে করেনি, নভেরাকে চাকরি দেওয়া হয়নি কেননা ওর পোশাক আশাক ও জীবন যাপন তখনকার শিল্পগুরুদের পছন্দ ছিল না। শামীমের সময় এসে পরিস্থিতি খানিকটা পাল্টেছিল, ১৯৮০ সনে শামীম শিকদার ঠিকই আর্ট কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেয়ে যান। শামীম শিকদারের পোশাক তাঁর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়নি।
শামীম শিকদার সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। সিরাজ শিকদার ছিলেন তাঁর বড় ভাই। সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর পর তিনি অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াতেন ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার জন্যে এরকম একটা কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কোনো তথ্য কোথাও দেখিনি। তাঁর নিত্যদিনের বন্ধুদের মধ্যেও সেরকম সক্রিয় রাজনীতিবিদ কারো নাম শুনিনি। আহম্মদ ছফার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। আড্ডা দিতেন ছফা, হুমায়ুন আহমেদ ওদের সাথে। হুমায়ুন আহমেদের বইতেও আপনি শামীম শিকদারের উল্লেখ পাবেন। ছফা শামীম শিকদারকে খুবই পছন্দ করতেন। ছফার স্বভাব ছিল তাঁর সময়ের প্রতিভাবান ও অগ্রসর মেয়েদের প্রেমে পড়ে যাওয়া ও তাঁদেরকে বিবাহ করতে চাওয়া। শামীম শিকদারকেও তিনি বিবাহের প্রস্তাব করেন, কিন্তু শামীম শিকদার তাতে রাজি হননি। শামীম শিকদার নিজেও ছফার ঐরকম যাকে দেখেন তাকেই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার স্বভাবের কথা ভালোভাবেই জানতেন। ছফাকে বিবাহের কোনো আগ্রহ শামীম শিকদারের ছিল না।
শামীম শিকদার জীবন যাপন করেছেন নিজের শর্তে, নিজের মতো করে এবং সেটা করতে গিয়ে তিনি নারীর জন্যে পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া আচরণবিধি মানেননি। এইটাই তাঁকে অনন্য করেছে এবং তাঁর এই বৈশিষ্ট্যই তাঁর পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে এবং ২০০১ সনের পর তিনি আর উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করেননি। শামীম শিকদার তাঁর প্রায় সকল শিল্পকর্মই নির্মাণ করেছেন ২০০১ সনের আগে এবং তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসাবে তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হয় ২০০০ সনে। ২০০১ সনে সরকার পরিবর্তন হয় আর নতুন সরকারের অংশীদার ছিল মৌলবাদীরা। সেই সময় থেকেই শামীম শিকদার হুমকি পেতে শুরু করেন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। সেসময় তিনি খুব একটা ঘর থেকে বের হতেন না আর কোথাও যেতে হলে তাঁকে নিরাপত্তারক্ষী সাথে নিয়ে যেতে হতো। যে শিল্পী একজন স্বাধীন মুক্ত পাখির মতো শহরে সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন, নিজের শিল্পকর্ম করতেন ক্যাম্পাসের এখানে সেখানে হাতুরি বাটাল নিয়ে, সেই শিল্পীর জন্যে ঘর থেকে বের হওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপর তিনি একসময় দেশত্যাগ করে বিলেতে চলে যান। সেই যে ২০০১ সনে তিনি লন্ডনে চলে গেলেন, এরপর মাঝখানে একবার বা দুইবার হয়তো গোপনে এসেছিলেন দেশে কিন্তু প্রকাশ্যে আর আসেননি।
শামীম শিকদারের প্রতি মৌলবাদীদের আক্রোশ ছিল অনেকদিনের। একজন নারী ছেলেদের মতো প্যান্টশার্ট পরে সাইকেলে ঘুরে বেড়াবে, মাথার চুল ছোট করে কেটে রাখবে, ভাস্কর্য করবে এইটুকুই তো মৌলবাদীরা সহ্য করবে না। সেই সাথে ছিল মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং নারী অধিকারের পক্ষে তাঁর শক্ত অবস্থান। মৌলবাদীরা যখন তসলিমা নাসরিনকে হত্যা করার জন্যে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, ঢাকা শহরে সিলেটে এবং দেশের নানা জায়গায় বিশাল বিশাল সব মিছিল হচ্ছিল মৌলবাদীদের তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে, সেই সময় তিনি তসলিমা নাসরিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তসলিমাকে নিজের বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছেন পরম মমতায়। সেই সাথে রাজপথে মিছিলও করেছেন তসলিমার পক্ষে নিয়ে। সেই কঠিন সময়ে মৌলবাদীদের বিশাল বিশাল সব মিছিলে যখন রাজপথ আক্রান্ত, তখন অল্প কিছু মানুষকে নিয়ে তসলিমা নাসরিনের পক্ষে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করা – সে ছিল একটা অসীম সাহসিকতার কাজ। মৌলবাদীরা যে তাঁর উপর ক্রুদ্ধ থাকবে সেটাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ফলে দেশে থাকতে পারেননি শামীম শিকদার আর আমরা বঞ্চিত হয়েছি তাঁর শিল্পকর্ম থেকে।
দেশে তিনি ফিরে এসেছেন ঠিকই – যেন শেষ নিঃশ্বাসটি দেশের মাটিতে নেবেন বলেই তিনি এবার দেশে এসেছিলেন। দেশে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেখান থেকে আর সুস্থ হয়ে ফিরে আসেননি। চলে গেলেন ঠিকই, তবে শামীম শিকদার রয়ে যাবেন আমাদের দেশে অসংখ্য নারীর অন্তরে দুরন্ত সাহসের প্রতীক হয়ে, অনুপ্রেরণা হয়ে। তাঁর শিল্পকর্মের চেয়ে এই সাহসিকা পরিচয়ই সম্ভবত অধিক স্মৃত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]
“শামীম শিকদার জীবন যাপন করেছেন নিজের শর্তে, নিজের মতো করে এবং সেটা করতে গিয়ে তিনি নারীর জন্যে পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া আচরণবিধি মানেননি।”—-
পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া কোন আচরণবিধি মানেননি, যেটি অন্য নারীরা মানেন- সেটি উল্লেখ করলে জানতে পারতাম। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ