November 2, 2024
মুক্তমত

নারী ও পুরুষ : বন্ধুত্ব ও শরীর

আহমেদ ফারুক মীর ।। যুগে যুগে নারী বিষয়ে পুরুষে পুরুষে যুদ্ধ, ধ্বংস, রক্তারক্তি এসব হয়েছে মূলত কী নিয়ে? নিশ্চয়ই প্রথম এবং শেষতক এই উত্তরেই আমরা সন্তুষ্ট থাকবো যে, নারীর শরীর এবং নারীর দখলদারিত্ব নিয়ে। নারীর দখলদারিত্ব বলতে প্রথমত নারীর শরীরেরই দখলদারিত্ব বোঝানো হয়। মনের দখলদারিত্বের বিষয়টি প্রারম্ভিক পর্যায়ে মগজে নাও আসতে পারে। যেহেতু দেখা গিয়েছে কোনো এক নারী একজন পুরুষকে ভালোবাসেন অথচ অন্য এক ক্ষমতাওয়ালা পুরুষের সেই নারীকেই চাই। সেই নারীকে চাই অর্থ হলো, প্রথমত তার শরীরকে চাই। যেহেতু সেই নারীর মন ইতোমধ্যে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের কাছে জমা পড়ে আছে। সুতরাং মনের দখলদারিত্ব অগ্রগণ্যতার ভিত্তিতে না পেলেও নারীর দখলদারিত্বের আগ্রহে এখনও পর্যন্ত পুরুষের কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে মনে হয় না। নারীর নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি কিন্তু এখানে কোনো ভূমিকা পালন করছে না। অথচ আমরা পৃথিবীর প্রাচীনতম ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবো নারীর পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি সৃষ্টির শুরু থেকে গৌণ ভূমিকা পালণ করেনি। বরং পুরুষ কর্তৃক শক্তি প্রয়োগের এই আগ্রাসন একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে এবং ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে।

নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব বিষয়ক মতবাদের ক্ষেত্রে পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতি এই আগ্রাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ এই আগ্রাসন থেকেই আসে শরীর, দখলদারিত্ব ও অসমতা। অথচ নারী এবং পুরুষের বন্ধুত্বের আগপাছ বিবেচনা করলে দেখা যায়, বন্ধুত্বের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারী এবং পুরুষের বন্ধুত্ব কথাটি অনেকের কাছে এমন কি মা বাবার কাছেও মোটামুটিভাবে শিথিল হিসেবেই গণ্য ছিল। অর্থাৎ কোনো অঘটন ঘটার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা মেনে নেই যে, নারীতে পুরুষে বন্ধুত্ব হতে পারে। অথবা প্রাথমিক পর্যায়ে বিতর্কিত বিষয়টি কারো মাথায় আসেই না। কিন্তু আইরিশ কবি ও নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ডের মতামতের সাথে একমত একটি শ্রেণি ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন যে, নারী এবং পুরুষে অন্য সব কিছু হওয়া সম্ভব হলেও কোনোভাবেই বন্ধুত্ব হতে পারে না। এবং সুসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদও এতদবিষয়ে অস্কার ওয়াইল্ডের সাথে সহমত ছিলেন। সুতরাং ‘নারী-পুরুষে বন্ধুত্ব হতে পারে না’ বিষয়ে তাদের যুক্তি কী?

তাদের যুক্তি হলো, বন্ধুত্বের মাধ্যমে যেহেতু মানুষে মানুষে হৃদ্যতা বাড়ে সেহেতু নারী ও পুরুষের মধ্যবর্তী এই হৃদ্যতা এক সময় শরীর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। সুতরাং তাদের কট্টর ধারণা জন্মেছে যে, নারী ও পুরুষ শরীর পর্যন্ত পৌঁছানো মানে হলো তারা আর বন্ধু নেই, অন্য কিছু হয়ে গিয়েছে। অথচ ছোট ছোট শিশুদের মধ্যেও কিন্তু বন্ধুত্ব হয়, যখন তাদের মধ্যে নারী অথবা পুরুষ বিষয়ক কোনো বোধই উদয় হয় না। সুতরাং বন্ধুত্ব এমন একটি বিষয় যা, যে কারও মধ্যে, যে কোনো ভাবে, যে কোনো সময়ে গড়ে উঠতে পারে। নারী-পুরুষ, বাঙালি-আদিবাসি, খ্রিষ্টান-হিন্দু, শিশু-বৃদ্ধ এবং আরও অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গিয়ে তার বিভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে অথবা যে কোনো সময় ভেঙেও যেতে পারে। মূলত বন্ধুত্বে স্থির থাকা পর্যন্ত এটি হলো একটি বিশ্বস্ত সম্পর্ক, যে সম্পর্কে একজন সব সময় অপরজনের মঙ্গল কামনা করে থাকে এবং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যদিয়ে যায়।

বন্ধুত্বের মধ্যে যেহেতু হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, আরও অনেক কিছুই হতে পারে তাহলে শুধুমাত্র শরীরকে কেন্দ্র করে কেন বন্ধুত্ব – অবন্ধুত্বের বিচার করা হবে? বন্ধুত্বে হোক আর অন্য কোনো সম্পর্কেই হোক, ঘটনার আকস্মিকতায় সম্পর্কের মাঝে শরীর আসতে পারে, তাতে চলমান সম্পর্ক বদলে কিংবা ভেঙে যাওয়া সম্ভব কেমন করে? আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে বন্ধুত্বের মাঝে ঘটনাক্রমে শরীর চলে আসলে বন্ধুপ্রীতি থাকবে কিংবা থাকবে না এতদবিষয়ে আরও অধিক ভাবনার অবকাশ আছে।

যারা ভাবেন নারী-পুরুষে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে না, তারা সম্পর্কটিকে মর্যাদা না দিয়ে শরীর এবং দখলদারিত্বকে অগ্রগণ্যতা দেন বলেই হয়তো তাদের কাছে এমনটি মনে হয়। কারণ তারা ধরেই নেন, কোনো নারী এবং পুরষ কোনো কারণে যৌনতার কাছে পরাভূত হয়েছে মানে দুজনে একে অপরের সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হবে। অথচ এটি আগাগোড়া একটি অমূলক ধারণা। নারী-পুরুষে হোক, পুরুষে-পুরুষে হোক – বন্ধুত্ব একটি আলাদা বিষয়। বন্ধুত্বের মধ্যে কোন ঘটনা ঘটে থাকলে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্তে আসতে পারে তারা কি একই অবস্থায় থাকবে অথবা সম্পর্ক অন্য দিকে মোড় নিতে দেবে এবং সম্পর্ক অন্য দিকে মোড় নিলেও বিষয়টি একান্তই তাদের ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট থেকেই আসে।

যদি কোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক দাম্পত্য জীবনের দিকেও গড়ায় তখন সে সম্পর্ক শুধু কাগুজে না হয়ে তার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেই বরং তা আরও বেশি জোরদার এবং আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। হুট করে তৈরি হওয়া কাগুজে দাম্পত্য সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটি অদৃশ্য দেয়াল থেকে যায় বলে অনেকেই মনে করেন। সুতরাং হঠাৎ করে তৈরি হওয়া দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের বিষয়ে ঘোরতর অবিশ্বস্ততার মধ্যেও থাকতে পারে। অথচ সত্যিকারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক যেহেতু একটি বিশ্বস্ত সম্পর্ক সেহেতু এখানে অনেক বিষয় স্বেচ্ছায় একজন অপরজনের কাছে শেয়ার করে।

আমরা যেহেতু পৃথিবীর মারকাট পেছনে রেখে এই সময়ে এসে দখলদারিত্ব বিষয়টিকেই আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলতে চাই, তাহলে নারী কিংবা পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বা কেন শরীরের দখলদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এমন অমূলক মতামতকে অনুমোদন করতে যাব? বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার অসংখ্য কারণের মধ্যে নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে কেন শরীর কিংবা যৌনতাকে কেন্দ্র করে চুড়ান্ত করতে হবে? সুতরাং বন্ধুত্বকে নির্দিষ্ট কোনো ছাঁচের মধ্যে ফেলে তার সংজ্ঞা নিরুপণ করার সময় হয়তো ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

অতএব যৌনতার মতো প্রকৃতিগত বিষয়াষয়কে স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারলে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারবো যে, নারী পুরুষে বন্ধুত্ব হতে পারে। এবং শেষমেশ বলবো, যৌনতা অসম্ভব চমৎকার একটি প্রকৃতিগত বিষয়। কিন্তু এই বিষয়ে কারো উপর কারো কর্তৃত্ব কিংবা অধিকার খাটে না। শুধু যৌনতাই নয়, কোনো সম্পর্ক এবং কোনো বিষয়েই এক মানুষ অন্য মানুষের ইচ্ছের উপর কোনো কর্তৃত্ব কিংবা অধিকার ফলাতে পারে না। প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজের জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে এবং এটিই সমীচীন। বন্ধুত্ব হোক বা অন্য যেকোনো সম্পর্কেই হোক, নারী ও পুরুষ দুটি বিষয়কে আলাদা করে না ভেবে মানুষকে মানুষ ভাবতে পারলেই আমরা আমাদের মনের সকল জটিল ও কুটিল প্রশ্ন থেকে মুক্তি পাবো।

One thought on “নারী ও পুরুষ : বন্ধুত্ব ও শরীর

  • আহমেদ ফারুক মীর ভালো লেখেন। এ কারণে তাঁর লেখা ভালো নয় যে তাঁর ঝরঝরে ভাষা, মাত্রাজ্ঞান, তাত্ত্বিক দক্ষতা ভালো, বরং এজন্য ভালো, কারণ তিনি মূল বিষয়ের গভীরে ঢুকতে পারেন খুব পাণ্ডিত্য দেখাবার লোভ ছাড়াই।

    নারী ও পুরুষের লিঙ্গীক রসায়নের ঊর্ধ্বে মানবিক সম্পর্ক যখন রক্ত সম্পর্কিত পারিবারিক সংজ্ঞার বেড়াজাল ডিঙিয়ে যৌনতার স্থূলতা অতিক্রম করে নিষ্কাম সাহচর্য বা ভক্তির রূপে মুক্তির নির্মলতা আনে, তাকে খুব নির্মোহ দৃষ্টিতে নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করেছেন মীর।

    তাই আনন্দ হয় তাঁর লেখা পড়লে, ঈর্ষা নয়।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *