নারীই কি জানে সমতা ও স্বাধীনতার মানে?
আঞ্জুমান রোজী ।। নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার বিষয়টি যেসব নারী বোঝার ক্ষমতা রাখে না বা বোঝার চেষ্টা করে না, তারা সমাজের পরগাছা হয়ে বেঁচে আছে। নারীবাদ বিষয়টা এদের জন্য অনেক দূরের বিষয়। বোধ-বুদ্ধি-বিবেক-বিবেচনা যখন শূন্যের কোঠায় থাকে তখন এদের বুঝিয়েও কিচ্ছু করা সম্ভব নয়। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। এরা ধরেই নেয় নারী মানে দুর্বল, নারী মানেই অবলা। সমাজ-সংসার এবং পুরুষ যেভাবেই নারীকে দেখুক না কেন, মোদ্দাকথা হলো নারী নিজেকে কিভাবে দেখতে চায় – নারী মানে আহ্লাদী, অবলা, দুর্বল রূপে না-কি শিক্ষা দীক্ষায় জ্ঞানগরিমায় স্বাধীনচেতা মানুষ রূপে! তবে এটাও সত্য, প্রকৃতিগতভাবে নারীপুরুষ কেউই পরাধীন থাকতে চায় না।
যেসব নারী পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে চায়, তাদের কাছে নারী স্বাধীনতা বিষয়টি বিরক্তির কারণ বটে। এরা অন্যের কাছে হাত পেতে, মাথা নত করে জীবন কাটায়। অন্যের অনুমতি ছাড়া কোনো কাজ নিজ সিদ্ধান্তে করার ক্ষমতাও রাখে না; কিম্বা ক্ষমতা থাকলেও সমাজ-সংসারের ভয়ে এবং লজ্জায় সেটা প্রকাশ করার সাহস রাখে না। এসবের সূত্রপাত অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিকতায়। অর্থাৎ পুরুষের সুবিধার জন্য সমাজ-সংসারে সব রীতিনীতির প্রচলন। এই পুরুষতান্ত্রিকতা বুঝতে হলে নারীবাদ বিষয় বুঝতে হবে, তার জন্য দরকার প্রচুর পড়াশোনা। এই পড়াশোনা কাজটা পরনির্ভরশীল নারীরা কতটুকু করে? এরচেয়ে তারা বেশি ব্যস্ত থাকে কিভাবে একটা পুরুষের মন রক্ষা করে চলবে, তার জন্য চলে যত কূটকৌশলের চর্চা। কারণ এরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল।
আবার আরেক ধরনের নারী আছে যারা নারী স্বাধীনতার সবটুকু ভোগ করবে, পুরুষের উপর কর্তৃত্বও করবে, কারো কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করে নিজের মতো করে সবকিছু করবে, কিন্তু তারা নারীবাদ বিষয়টি বোঝা তো দূরে থাক নারী স্বাধীনতা বা নারী অধিকার নিয়ে কথা বললে ক্ষেপে যাবে। এরা ধর্মের লেবাসে চলুক আর না চলুক মনেপ্রাণে এক্কেবারে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করে। উপরে উপরে দেখা যায় এরা নিজেদের ব্যাপারে খুবই সচেতন কিন্তু নারীবাদে তাদের যত আপত্তি। অথচ নারীবাদের সমস্ত কুশল ভোগ করেই তারা চলছে, সমস্যা তাদের নারী স্বাধীনতায় স্বীকৃতি দেয়াতে। এর মধ্যে অবশ্যই ভয় লজ্জার ব্যাপার আছে, আছে সাহসিকতার অভাব।
প্রাকৃতিকভাবে নারীর নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। যেমন আছে পুরুষের নিজস্ব সৌন্দর্য। কিন্তু এর বাইরে সবকিছুর উর্ধ্বে অর্থাৎ শরীরবৃত্তীয় পার্থক্য ছাড়া মগজে মননে নারী ও পুরুষ সমান মানুষ। নারী-পুরুষের মানুষ সত্তায় কোনো পার্থক্য নেই। চিন্তা-চেতনায়-দূরদর্শিতায় নারী কোনো অংশে কম নয়। এর প্রমাণ নারী যুগ যুগ ধরে দিয়ে আসছে। নারী ইচ্ছে করলে নিজের ইচ্ছায় জীবনযাপন করতে পারে, যা উন্নত বিশ্বে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু তৃতীয় বিশ্বে এখনো নারী পুরুষের অধীন। কিংবা বলতে পারি এখনো তারা অন্ধকার যুগে ডুবে আছে। এজন্য সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্র দায়ী হলেও একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যায়, নারী কি আসলেই বন্দী জীবন পছন্দ করে?
না, কোনো নারীই বন্দিত্ব চায় না। মনেপ্রাণে প্রত্যেক নারী স্বাধীন, উন্মুক্ত। পুরুষতান্ত্রিকতার ছোবলে নারী বন্দী দশায় জীবনযাপন করছে। যারা করছে না তারা সব প্রথা ভেঙে বের হয়ে আসছে। এরাই আলোর পথিক, এরাই প্রগতির ধারক। যদিও সমাজ-সংসার তা পছন্দ করে না। হাজার হাজার বছরের নিয়ম ভেঙে নারী বের হয়ে আসছে, তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পছন্দ করবে কেন? তারপরও ভাঙ্গছে। এই উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার হাত ধরে তসলিমা নাসরিন হয়ে স্বাধীনচেতা নারী সব প্রথা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। যারা এই প্রথা ভাঙ্গতে পারছে না, তারাই পুরুষের ছায়াতলে নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। তারাই বলে, নারী কেন পুরুষের মতো চলবে? কারণ এসব নারীর কাছে স্বাধীনতা মানে পুরুষের মতো চলাফেরা। অথচ স্বাধীনতা শব্দটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান প্রযোজ্য৷ তা নারী তার নিজস্ব সৌন্দর্য রক্ষা করেও ভোগ করতে পারে, যেভাবে পুরুষ করছে৷ এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা-মেধা এবং মননের চর্চা, যা তাকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে তোলে; সেইসাথে বুঝিয়ে দেয় স্বাধীনতার মর্ম ও মানুষ সত্তার মর্ম।
তাছাড়া নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই সবকিছুর মুক্তি আসে না, যদি নারী তার প্রথাসিদ্ধ অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা না বদলায় বা তার বলয় থেকে যদি বের হয়ে না আসে। এ কথাও চূড়ান্তভাবে সত্য, মাথা উঁচু করে চলার অধিকার না পেলে এমন অর্থনৈতিক মুক্তিও কোনো উন্নয়নের সোপানে পৌঁছাবে না। তাই বলছি, নারীপুরুষ যারা মানুষ সত্তায় বেঁচে আছে, পৃথিবীটাকে দেখছে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বাসস্থান হিসেবে, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ভুলে গিয়ে করছে সকল কর্মকাণ্ডের সমান মূল্যায়ন; তাদের কাছে পৃথিবীটা আসলেই সুন্দর। কোনো নারীপুরুষ কোনো লিঙ্গ পরিচয়ে পরিচিত নয়, পরিচয় হবে তার কর্মে, তার মানুষ সত্তায়, অবশ্যই লিঙ্গ বিশেষণে নয়। যেসব নারী লিঙ্গ পরিচয়ে বাঁচতে চায়, তাদের জন্য সত্যিই করুণা হয়। শুধু নারী নয়, মানুষ সত্তায় বাঁচার অঙ্গীকার হোক প্রতিটি নারীর।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। কানাডায় হাসপাতালের মতো কিছু জায়গায় সরকারি ফর্মে লিঙ্গের উল্লেখ থাকছে, আর সব স্থান থেকে লৈঙ্গিক পরিচিতিটা উঠে যাচ্ছে। কারণ এখন লিঙ্গ মোট চার রকমের- পুরুষ, স্ত্রী, কমন এবং ট্রান্সজেন্ডার। বৈষম্য হবার কারণে উঠিয়ে দেয়া হবে লৈঙ্গিক পরিচয়ের বেড়া। তার মানে মানুষ হওয়ার পথে বড় এক পদক্ষেপ। টরন্টোর ডাউন টাউনে ঘুরতে ঘুরতে এমন এক বিষয়ের খুঁজে পেয়েছিলাম, যা হলো নারী+পুরুষ=মানুষ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]