November 21, 2024
মুক্তমত

চিত্ত হোক বিত্তবান

আহমেদ ফারুক মীর ।।

এক.
যে নারীরা চুলে ফুল দিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, জামার ওপর ওড়না ঝুলিয়ে রাখার মতো ধৈর্য যেসব নারীর কম থাকে কিংবা থাকেই না, যে নারীরা কপালে বিশাল বড় টিপ সেঁটে দেয় অথবা অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়া চুলগুলো বিনা শর্তে কেটে ফেলার সময় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাপকরা কী ভাবছে এবং ভাবতে পারে তা মাথায় রাখার প্রয়োজন বোধ করে না তারা সাধারণের মতো নয়। তারা অন্য রকম। নসিহতের মাধ্যমে তাদেরকে পরিবর্তন করার মানসিকতা নিয়ে তাদের প্রেমে পড়া সহজ। এমন অনেক পুরুষকেই আমি জানি যারা নারীর মনোবৃত্তিকে পরিবর্তন কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা নিয়ে নিজ স্বপ্নে অটল এমন নারীদের কবজায় আনার ইচ্ছা পোষণ করে আছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমি যে ঘরানার নারীদের কথা বলছি তাদেরকে প্রেমে পড়ানো ততটা সহজ নয় যতটা সাধারণ পুরুষ হিসেবে আমি অথবা আমরা ভেবে থাকি। কারণ এই নারীরা ফিসফিস করে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না। একান্ত নিজের ইচ্ছেয় ছাড়া সিনেমা হলে অথবা প্রেমগলির অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গাটুকুতে লুকিয়ে কারও সাথে দেখা করার বিষয়ে সচরাচর তাদের অনিহা বললেই চলে।

অথচ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেক মানুষ ধরেই নেয়, যারা নিজেদের আবৃত করে চলাফেরা করে তাদের চেয়ে অনেকাংশে খোলামেলা নারীরা সস্তা এবং যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোর মতোই যত্রতত্র প্রেমে পড়ে যেতেও তারা দ্বিধা করে না। এই মনোভাব নিয়ে আমরা যারা বেঁচে আছি, একবার ঐসমস্ত নারীদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন, তাদের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার ইলেক্ট্রিক ইল এর মতোই দ্রুতগতিসম্পন্ন।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অসংখ্য পুরুষ আমরা দেখেছি যারা ধরে নিয়েছে যে, নিজেকে সুন্দর করে সাজানো নারীদের সকল নান্দনিকতা শুধুমাত্র পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য। এবং ঢালাওভাবে অনেক পুরুষ ধরে নেয় সব মেয়েদের সকল ধরনের গতিবিধিই তাদেরকে খুশি করার জন্য। অনেক পুরুষের ধারণাই নেই যে, প্রতিটি নারীই আলাদা আলাদা মানুষ এবং প্রতিটি নারীরই নিজস্ব মনস্তত্ত্ব আছে, যা অসম্ভব সুন্দর এবং অনেকের চিন্তার চেয়েও বহুগুণ উঁচু ও শক্তিমান। এবং তাদের সেই মনটিতে অনবদ্যভাবেই নানান রঙ খেলা করে। পুরুষ ছাড়াও তাদের চারপাশে ভালোবাসার মতো অসংখ্য উপাদান তারা পেয়ে যায়। তারা কখনোই পুরুষতান্ত্রিক শক্তির ওপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠে না। বহু পুরুষ সারা জীবন চেষ্টা করেও এ ধরনের নারীর মনের নাগাল পায় না। কারণ বহু নারী ইতোমধ্যে নিজেকে ভালোবাসতে শিখে গিয়েছে। সুতরাং পুরুষসঙ্গ না পেলে কিংবা পুরুষকে সঙ্গ না দিলে তাদের কিছুই এসে যায় না।

দুই.
কিন্তু পুরুষদের আশ্বস্ত হওয়ার বিষয়ও আছে। কারণ এমন অনেক নারী আছেন যাদেরকে তাদের পিতা, মাতা শিশুকাল থেকেই শিখিয়ে দিয়েছে ‘শুধুমাত্র পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্যই নারীর জন্ম’। এমন নারীদের নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই এবং তারা অনেকটা ব্যক্তিগত পুতুলের মতোই জীবন যাপন করে। তারা উপদেশদাতা পুরুষদের মনের মতোই নিজেকে সাজায় কিংবা বন্দি করে কিংবা সাময়িকভাবে মুক্ত করে। একজন প্রভাব বিস্তারকারী পুরুষ হিসেবে আমার কিংবা আপনার মেয়েও ঠিক এমন নারীদের মতোই হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা নারী জাতির লুকিয়ে থাকাকেই তাদের নারীত্ব, কৃতিত্ব, সৌন্দর্য এবং অধিকার মনে করি। সুতরাং আমাদের মেয়েরা কি নিজেদের চেতনার মতো শক্তিমান মানসিকতাসম্পন্ন হবে, নাকি আপনার কিংবা আমার মতো কোনো প্রভাব বিস্তারকারী পুরুষের তুড়ির পুতুল হয়ে বেঁচে থাকবে সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে। নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে আমরা যা ভাবি অন্য নারীর ক্ষেত্রেও সেভাবে ভাবার মানসিকতা না থাকলে আমাদের ভাবনাগুলো বিফলেই যাবে বলে মনে হয়।

নারীরা যাকে যোগ্য মনে করে তাকে মন উজার করে ভালোবাসতে পারে। মননের দিক থেকে শক্ত নারীরা বিবেচনার দিক দিয়ে বেশি বিনয়ী এবং নিখুঁত। এ ধরনের নারীরা আপনার প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনে নিজ উদ্যোগে আপনাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। কারণ তারা নিজস্ব চিন্তায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কারও নির্দেশের প্রয়োজন মনে করে না। এমন ঘরানার নারীরা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকতেও অস্বীকার করে।

বিপরীত দিক থেকে দেখা যায়, নারীদের মধ্যে যারা অপরাধ জগতে সবচেয়ে ভালোভাবে নিজেকে পদায়ন করে নেয় তাদের বেশিরভাগ মুখোশাবৃতের মতো শরীরাবৃত থাকে। তাদেরকে দেখলে আপনার কিংবা আমার মনে তাদের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা আসবেই না। অথচ এই ধারণাটি তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে সবচেয় বড় ভুলের মধ্যে রাখে। বরং চলনে যারা খোলামেলা, বলনে যারা সোজাসাপটা, তারাই কম ক্রিটিকাল, কম ঝগড়াটে, কম কৌশলী হয়। কারণ তারা সহজ এবং সোজা জিনিসগুলোকে সোজাভাবে নিতে চায়। তারা তাদের বক্তব্য কিংবা অভিযোগ ক্ষমতাবান পুরুষের মুখের ওপর বলার সাহস নিয়ে জন্মায় কিংবা জন্মের পর তাদেরকে সাহস শেখানো হয়। পেছন থেকে চালিয়ে নেয়া ঘোরপ্যাঁচ তারা সহজে শেখে না।

কন্যা সন্তানকে সব কিছু শেখানোর আগে সাহস শেখানো জরুরি বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, যেন তার ওপর হয়ে থাকে এমন অন্যায়গুলোর সময় সে অন্তত মুখের ভাষায় হলেও প্রতিবাদের একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারে।

তিন.
এসবের বাইরেও এমন অনেক নারীই আছেন যারা অপেক্ষাকৃত চতুর এবং কৌশলী। তারা মানুষের দুর্বলতাকে সুবিধা হিসেবে গ্রহণ করে। কোনো না কোনো সময় সেসব নারীদেরকে প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়। যারা ব্যক্তিত্বের দিক থেকে আপস করে তারা সমাজের দিক থেকে (বিশেষ করে পুরুষদের দিক থেকে) নানান সুবিধা ভোগ করে থাকে। কিন্তু এই সুবিধা তাদের ব্যক্তিত্বকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দেয়। যদিও তাদের ক্ষেত্রে অন্যের চেয়ে কম কাজ করার পরও কাজের ভালো ফলাফল দেখা যায়। কিন্তু এই ফলাফল তাদের কাজের ফলাফল নয়, তাদের ঝুলে পড়ার ফলাফল, নিজের শক্তিকে বিসর্জন দেয়ার ফলাফল, নিজের ব্যক্তিত্বকে গুলিবিদ্ধ করার ফলাফল। কিন্তু সত্যি বলতে আমি কর্মক্ষেত্রে বহু নারীকেই দেখেছি যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে কয়ে নিজের সুবিধা আদায় করার প্রতিই বেশি আগ্রহী। কিয়দাংশ বাদে এতে অধিকাংশ পুরুষের সুনজরে থাকা যায়।

অতএব নারীকে পুরুষ অধিকার করার দোষটি শুধুমাত্র পুরুষের ঘাড়ে দিলেই হয় না। এতে নারীদের ঐচ্ছিক সুবিধাভোগের লিপ্সাও কম থাকে না। বরং আমার মনে হয় স্কুল, কলেজ থেকেই মন গলানোর কৌশলগুলো তারা শিখে থাকে। যখন স্কুলে পড়াশুনা করেছি তখন দেখেছি অধিকাংশ সহপাঠী মেয়েরা পুরুষ শিক্ষকদের সাথে কথা বলার সময় তাদের ভঙ্গি এমন থাকে, যেন তারা গলে যাচ্ছে, ঢলে পড়ে যাচ্ছে। অথচ নারী শিক্ষকদের সামনে তারা অন্য রকম। সুতরাং এসব চরিত্রের নারীরা কর্ম জীবনেও এমন গলে যাওয়াকে অগ্রগণ্যতাদিয়ে থাকে। কারণ এর সুফল তারা ইতোমধ্যে পেয়ে এসেছে।

লোভের পাশাপাশি চারিত্রিক শক্তি এবং দৃঢ়তা কম থাকলেই এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব। হয়তো বহু নারী মনে করতে পারে তাদের শারীরিক শক্তি কম, তাদের মানসিক শক্তিও কম। সুতরাং পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে থাকাই অধিকতর বুদ্ধির কাজ। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? চিত্তের শক্তি না থাকলে নারী পিছিয়ে থাকবেই। চিত্তের শক্তি না থাকলে পুরুষ নারীকে করুণার চোখে দেখবেই। চিত্তের শক্তি না থাকলে পুরুষ নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাববেই। সুতরাং নারীকে হতে হবে এমন নারী যাদের কথা আমি নিবন্ধের প্রথমেই বলেছি। চিত্তকে বিত্তবান করার সাহস হোক নারীর। নারী ঘুরে দাঁড়াক।

বিঃ দ্রঃ নিবন্ধের শেষাংশে এসে দোষের বোঝাটি নারীর উপরেই বর্তায়। সুতরাং এটাই সমীচীন যখন নারীদের মধ্যে অধিকার এবং কর্তব্যবিষয়ক বোধ জন্ম নেবে। এবং তাদের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেয়ার চিন্তা মাথা থেকে ছেটে ফেলতে পারবে, তখনই নারীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখবে এবং পুরুষরা নারীদের আর করুণা করার সুযোগ কিংবা সাহস কোনোটাই পাবে না।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *