জেন্ডার ইকুয়ালিটির শো পিস
মাসকাওয়াথ আহসান।। একটা টিভি স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছিলো সারা। হেড অফ নিউজের সঙ্গে মিটিং আছে। দেশের বাইরে থেকে ফিরেছে সে। বিদেশি মিডিয়ায় কাজ শিখে ফিরেছে; দেশের মিডিয়ায় এরকম সংবাদকর্মীর প্রয়োজন আছে। ফলে ফোনেই কাজটা পাকা হয়ে গেছে। আজ কেবল চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের পালা।
ওয়েটিং রুমে ছোট চুলের এক তরুণীকে বসে থাকতে দেখে একজন মাঝবয়েসী টকশো উপস্থাপক-সাংবাদিক এগিয়ে আসে। সে মনে করে, সবাই তার টকশো দেখে; আর সে এতোই বিখ্যাত যে সবাই তাকে চিনবে।
সারা যেহেতু দেশের বাইরে ছিলো; ফলে দেশের টিভির টকশো হোস্টদের চিনে উঠতে পারেনি। মাঝবয়েসী উপস্থাপক প্রগলভ হয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি কী কোন সাহায্য করতে পারি!
সারা লোকটির চোখ মার্বেলের মতো ঘুরতে দেখে বিরক্ত হয়। সে সংক্ষেপে বলে, আই এম গুড। প্লিজ ক্যারি অন উইথ ইওর ওয়ার্ক।
সেলিব্রেটি উপস্থাপক ক্ষুব্ধ হয়। চোখ মুখ লাল করে বেরিয়ে যায়। সারা একটু পরে যখন হেড অব নিউজের কক্ষে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করছিলো; তখন সেখানে ঢুকে আবার ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে যায় সেলিব্রেটি।
সারা কাজে যোগদানের পর তাকে টকশোগুলো প্রযোজনার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিছু দিনের মধ্যেই নারী-পুরুষ টকশো হোস্টদের প্রচলিত ঢং, দেরি করে আসা ও দাপটের দফার রফা ফিশরোল হয়ে যায়। কাজের সময় সারা যেহেতু অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না; ফলে শীঘ্রই সেলিব্রেটিদের চোখের বিষ হয়ে পড়ে সে। পিসি আর থেকে টকব্যাকে গেস্টকে কী প্রশ্ন করতে হবে তা হোস্টকে যেহেতু সেই বলে দেয়; ফলে হোস্টরা অতোটা রাগও দেখাতে পারে না।
একজন নারীর সুপার ভিশনে কাজ করতে কিছু পুরুষ-কর্মীর বেশ অপমানিত বোধ হয়। কেউ কেউ এ কথাটা বলতে চেষ্টা করে, পর্দা-পুসিদা নাই; সহীহভাবে চলে না সে।
সারা যেহেতু কাজে বেশ ভালো; এসব আলগা কথা-বার্তা দিয়ে কিছুতেই কারো কার্যসিদ্ধি হয় না। কিছু নারী কর্মী এসে ক্ষুব্ধ পুরুষ-কর্মীদের ক্ষোভে ঘৃতাহুতি দিয়ে বলে, মেয়ে মানুষ এমন কেন হবে ভাই; সে কেন পুরুষের মুখে মুখে তর্ক করবে। জানি না এই মেয়ের হাজব্যান্ড তাকে কী করে সহ্য করে!
কিছুদিন পরে প্রেসক্লাবে সারার হাজব্যান্ডের সঙ্গে দেখা হলে এক ফিমেল হোস্ট এসে খাতির জমায়। বুঝতে চেষ্টা করে লোকটা তার ঝগড়ুটে স্ত্রীকে নিয়ে কতটা দুঃখে আছে। ফিমেল হোস্ট তার নিজের হাজব্যান্ডের সঙ্গে ঝগড়ার গল্পটা তোলে হাসতে হাসতে। কিন্তু সারার হাজব্যান্ড এই গল্পের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারে না। ফলে হাসি হাসি মুখে গল্প শুনতে শুনতে বলে, আমি তো ভেবেছিলাম, মানুষজন আজকাল টিভি টকশোর ঝগড়া শুনে শুনে আর ফেসবুকে ঝগড়া করে নিজেরা ঝগড়া করার সময় পায় না।
ফিমেল হোস্ট হতাশ হয়ে ফিরে যায়। অফিসে সারার সঙ্গে খাতির জমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সারা ঠিক অতোটা খাতিরের মানুষ নয়। কাজের বাইরে খেজুরে আলাপে তার একদম আগ্রহ নেই। তবে ধীরে ধীরে অফিসে সবাই বুঝতে পারে এর সঙ্গে কোন মতে মানিয়ে চলা ছাড়া কোন উপায় নেই।
নিউজরুমে বসে মেয়েদের সামনে বসে রসিয়ে রসিয়ে আদি-রসাত্মক কৌতুক বলার সরস দিনগুলো যেন ফুরিয়ে আসতে থাকে। সারা গল্পের ছলে ভীতি ছড়িয়ে দেয়, আজকাল ‘মি টু’-র যে প্রচলন হয়েছে; আর ‘ফিমেল হ্যারাসমেন্ট কমিটি’ হয়েছে; রস করতে গিয়ে কখন কার চাকরি চলে যায়।
সারার প্রমোশান ও ইনক্রিমেন্ট ডিউ হলে হেড অফ নিউজ হাসতে হাসতে বলে, এতো টাকা দিয়ে কী করবেন! আপনার হাজব্যান্ডের টাকাই তো যথেষ্ট। আপনারটা তো এক্সট্রা।
সারাও হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, ওটা তো অষ্টাদশ শতাব্দির কনসেপ্ট। এ যুগে হাজব্যান্ড আর ওয়াইফ দুজনেরই নিজের নিজের ক্যারিয়ার থাকে। আর সে যুগে আমার মায়েরই তো ক্যারিয়ার ছিলো।
নিউজরুমে বসে কেউ টাকা-পয়সার অভাবে হা-হুতাশ করলে সারা সোজা-সাপটা বলে দেয়, স্ত্রীকে বাসায় বসিয়ে না রেখে একটা কাজ করতে দিলেই দেখবেন জীবনটা সহজ হয়ে আসবে।
ওদিকে কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার ভারসাম্যের ব্যাপারটা বেশ প্রচলিত হতে থাকে। পশ্চিমা দেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল, জাতিসংঘের জেন্ডার বিষয়ক প্রতিনিধি দল মিডিয়া হাউজ পরিদর্শনে এসে একটা কমন প্রশ্ন করে, আপনাদের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে নারীর অংশগ্রহণ কেমন!
সারাই যেহেতু একমাত্র নারী যে সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে আছে; তাকে দিয়েই বার বার মুখ রক্ষা করতে হয়। পশ্চিমা প্রতিনিধিদলে আজকাল বেশির ভাগই নারী। ফলে নানা ইস্যুতে সারাকেই নানা প্রশ্ন করে তারা।
এ এক ভারী বিপদ হয়ে দাঁড়ায় হেড অফ নিউজের জন্য। জেন্ডার ভারসাম্যের ট্রেন্ড নিয়ে রসিকতার ছলে একদিন বলেন, ভয় হয় সারা, আমাকেই না কবে রিপ্লেস করে আপনাকে বসিয়ে দেয় ম্যানেজমেন্ট।
সারা হাসতে হাসতে বলে, তা হবে কেন, আমি হচ্ছি আপনাদের হাউজের জেন্ডার ইকুয়ালিটির শো পিস। সেই কুমির ছানার গল্পের মতো। সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে নারী আছে; এটা প্রমাণে বার বার একই কুমির ছানা দেখাতে হয়।