April 27, 2025
নারীবাদ আলোচনাফিচার ১

সাইবর্গ ফেমিনিজম: কল্পবিজ্ঞান নাকি বাস্তব?

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর ডেস্ক ।। “সাইবর্গ” শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে কোনো সিনেমার চরিত্র—আধা মানুষ, আধা যন্ত্র। রোবোকপ, টার্মিনেটর কিংবা মার্ভেল-এর কিছু চরিত্র। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছো, আমরা নিজেরাও কি একটু-আধটু সাইবর্গ নই?

একবার ভেবে দেখো—তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল দেখো, কাজের সময় ল্যাপটপে চোখ, রাতে ফেসবুকে চ্যাট। শরীরে হেডফোন, হাতে স্মার্টওয়াচ, এমনকি অনেকে তো হার্টে বা কানে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ঘোরে। আজ আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে মানুষ ও যন্ত্রের সংমিশ্রণ।

এই ভাবনাটাকেই দারুণ এক রাজনৈতিক ও নারীবাদী ভাষা দিয়েছেন ডোনা হ্যারাওয়ে, একজন মার্কিন বিজ্ঞান-লেখক ও ফেমিনিস্ট থিঙ্কার। তিনি ১৯৮৫ সালে লিখেছিলেন এক বিখ্যাত প্রবন্ধ, নাম—A Cyborg Manifesto।

Cyborg Feminism আসলে কী? 

ডোনা হ্যারাওয়ে বলেন, “আমরা সবাই সাইবর্গ”—এই কথা শুধু শরীরের কথা না, এটা একটা ভাবনা, দর্শন। Cyborg Feminism আসলে এমন এক নারীবাদ, যা ট্র্যাডিশনাল বা প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন পথ খোঁজে – যেখানে প্রযুক্তি, পরিচয়, লিঙ্গ, এবং ক্ষমতার সম্পর্কগুলো আবার নতুনভাবে ভাবা হয়।

কী কী বোঝাচ্ছে এই চিন্তা?

১. পরিচয় কোনো বাঁধাধরা বিষয় নয়: Cyborg feminism বলে, “তুমি মেয়ে বলেই তোমার এটা করা উচিত”, এই ধরনের চিন্তা এখন পুরনো হয়ে গেছে। তুমি নারী, তুমি প্রযুক্তিতে কাজ করো, তুমি নিজের শরীর বা যৌন পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করো – এই মিশ্রিত পরিচয়গুলোই বাস্তব। আমরা সবাই একেকটা সাইবর্গ, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি আর অভিজ্ঞতার মিশেলে তৈরি।

২. প্রযুক্তিকে ভয় না পেয়ে তার ব্যবহার শেখো: অনেকদিন ধরেই নারীবাদে একটা ভয় ছিল – প্রযুক্তি যেন পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার, যা নারীদের আরও কোণঠাসা করে। কিন্তু Cyborg feminism উল্টো বলে, প্রযুক্তিকে নারীরা নিজেদের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তুমি ইউটিউবে নিজের কথা বলো, ইনস্টাগ্রামে নিজের শিল্প তুলে ধরো, অনলাইনে নেটওয়ার্ক তৈরি করো – এসবই তো সাইবর্গ স্টাইলের নারীবাদ!

৩. নারীবাদ মানেই একরকম ভাবনা না: সাইবর্গ ফেমিনিজম বলে, সব নারীর অভিজ্ঞতা এক নয়। কেউ প্রযুক্তির সাথে খুব স্বচ্ছন্দ্যে, কেউ আবার গ্রাম বা শহরে একেবারে আলাদা জীবন যাপন করছে। তাই “নারীবাদ” মানে একটা একক আওয়াজ না, বরং বহু ধরনের কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠগুলো একেকজন নারীর, ট্রান্স মানুষের, প্রযুক্তিতে কাজ করা বা প্রযুক্তির বাইরে থাকা মানুষের।

বাস্তব জীবনে এর উদাহরণ

সোশ্যাল মিডিয়া: একজন নারী যদি নিজের গল্প ইনস্টাগ্রামে বলে – যেভাবে সে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে, বা সে কীভাবে নিজের কেরিয়ার গড়ছে – তাহলে সে প্রযুক্তির সাহায্যে একটা রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করছে।

ডিজিটাল আর্ট ও ফেমটেক: অনেক নারী আজ প্রযুক্তির সাহায্যে নিজের শরীর, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা নিয়ে আর্ট বানাচ্ছে, স্টার্টআপ তৈরি করছে, হেলথ অ্যাপ তৈরি করছে – এসবই সাইবর্গ ফেমিনিস্ট চিন্তার বাস্তব রূপ।

তাহলে আমরা সবাই কি সাইবর্গ?

একদিক থেকে হ্যাঁ। আমরা সবাই এক ধরনের মিশ্র পরিচয় নিয়ে বাঁচি। আমরা নারীবাদে বিশ্বাস ও চর্চা করি, কিন্তু সেটা প্রযুক্তির ভাষায়, মিমের মাধ্যমে, রিল ভিডিওতে, অথবা মেডিকেল প্রযুক্তির সাহায্যে। Cyborg feminism আমাদের বলে – তোমার পরিচয়কে তুমি নিজেই তৈরি করো, বাইরের সমাজ কী বলবে, সেটাই শেষ কথা না।

Cyborg Feminism আমাদের কী শেখায়?

পরিচয় অনেক রকম হতে পারে এবং সবটাই ঠিক। প্রযুক্তি একা পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার না, এটা নারীদেরও শক্তি হতে পারে। নারীবাদ মানে শুধু একজন নারীর কথা না, এখান সব ধরনের অভিজ্ঞতার স্থান থাকা উচিত। আমাদের মধ্যে প্রযুক্তি আর মনুষত্ব একসঙ্গে বাঁচে – এটাই নতুন জগতের বাস্তবতা।

শেষ কথা:  সাইবর্গ মানে স্বাধীনতা

Cyborg feminism কল্পবিজ্ঞান থেকে আসা এক সাহসী কল্পনা, কিন্তু এর প্রভাব একেবারে বাস্তব। এই ভাবনা আমাদের শেখায় – নিজেকে ভাঙো, প্রশ্ন করো, নতুনভাবে গড়ে তোলো। নারীবাদ মানে শুধু প্রতিবাদ না, এটা এক ধরনের কল্পনা, সৃষ্টি, আর মুক্তির গল্প।

 

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply