September 20, 2024
কলামফিচার ২

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কীসের এতো দায়?

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।। আজকাল ঘুমের মধ্যে টুকি খালার মুখটা ভেসে ওঠে প্রায়ই৷ এতো বছর পর কেন এমন হচ্ছে নিজেও জানি না। কারা যেন খবর দিলো টুকি খালাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি তখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী। টুকি খালাকে ওদের বাড়ির সামনের সবুজ ঘাসের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। তখনো মেরুন রঙের সালোয়ার – কামিজ পরনে। গলার কাছে নীলচে কালসিটে দাগ। জীবনে প্রথম কোনো মরদেহ দেখলাম। তাও আবার ময়নাতদন্ত করা। এক দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম আমি।

টুকি খালা মফস্বল শহরে আমার মামাদের প্রতিবেশী ছিলো। মামাদের বাড়ির গলিতে ঢুকতেই “আপা” বলে আমার মাকে ডাকতো। কৃষ্ণবর্ণ টুকি খালার ঝকঝকে হাসিখানি সন্ধ্যার অন্ধকারে জোছনার মতো লাগতো আমার। হাসির উচ্ছ্বাসে নাকছাবিটা থেকে থেকে ঝিলিক দিতো। হাসিখুশি মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো ভালোবাসার মানুষের সাথে। বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্যাসেট এনে দেখলাম আমরা। বছর না ঘুরতেই টুকি খালার মৃত্যুসংবাদ। শ্বশুরবাড়ি থেকে আত্মহত্যা বলা হলেও বাবা – মা হত্যা মামলা দায়ের করেছিলো। যতদূর জানি মামলার রায় ওদের পক্ষে যায়নি। শুনেছিলাম টুকি খালার শ্বশুরবাড়ি অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলো। জাতপাত আর পণ নিয়ে বিয়ের পর থেকে অপমান আর নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিলো। প্রেমের বিয়ে বলে বাবা – মায়ের কাছে গোপন করতো সেসব কথা। গোপন না করলে পরিবার থেকেও যে কেমন আচরণ পেতো তা অবশ্য জানা নেই। যে কোনো মূল্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো ও। তা করতে গিয়ে নিজের জীবনটাই বলিদান হয়ে গেলো।

আমাদের সমাজে বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পর্কের মূল্য দিতে গিয়ে প্রাণ হারানো বা নিজেকে বিপন্ন করার উদাহরণ ডাল – ভাতের মতো নিত্যনৈমিত্তিক। কারণ সমাজ থেকে সে এটাই শিখে বড় হয় যে, ভালো মেয়েদের জীবনে একবারই প্রেম আসে, তারা একবারই বিয়ে করে এবং একজন পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেলে তার জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। লোকসমাজ এই “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” দেখতে বড়ই ভালোবাসে। তাতে মেয়ে আজীবন অসুখী থাকুক, অসম্মানের জীবন বয়ে বেড়াক, বেলায় বেলায় গায়ে – পিঠে কালিসিটে নিয়ে ঘুরে বেড়াক, হাত – পা, ভাঙুক, চৌদ্দটা সেলাই পড়ুক কিংবা মরে যাক – তাতে কারো কিচ্ছু যায় আসে না। এতো কিছু সয়ে মেয়েটা সংসার ধরে রাখতে পেরেছে, বাচ্চাদের মুখ চেয়ে সয়ে নিয়েছে সব অনাচার – আহা! কী আদর্শ মেয়ে! যায় – আসে কেবল তখনই যখন মেয়ে অপমান সহ্য করতে না পেরে মুখ খোলে, মা – বাবাকে নির্যাতনের কথা জানিয়ে দেয়, সংসার করতে বা সম্পর্ক রাখতে অস্বীকৃতি জানায়। এমন অনেক পরিবার আছে যারা মেয়ের এই ফিরে আসা নিয়ে বিব্রত হয়। কয়দিন না যেতে বুঝিয়ে শুনিয়ে আরেকটু মানিয়ে নিয়ে সংসার করতে ফেরত পাঠায়। বোঝানো হয়, বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের একটাই ঘর সেটা স্বামীর ঘর। লাল শাড়িতে ঢুকে সাদা কাফনে স্বামীগৃহ ত্যাগ করার মাঝেই জীবনের সফলতার গল্প নিহিত৷ কখনো হয়তো অত্যাচারী স্বামী মহোদয়কে ডেকে দু’চারটে অম্লমধুর কথা বলে আবার চার হাত এক করে দেয়া হয়। মেয়ে শিক্ষিত, অশিক্ষিত যাই হোক সংসারে পুরুষের কুকর্ম ঢেকে রাখতে পারাটা এক বিরাট যোগ্যতা বটে!

নিজের কথাই বলি না কেন!

টুকি খালার এই করুণ পরিণতি থেকে আমার কিশোর বয়সের প্রজাপতিকাল শিক্ষা নিতে পারলো না। মিথ্যে প্রেমের ফাঁদে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। যে বয়সের প্রেমের চিঠিতে মুঠো মুঠো ভালোবাসা থাকে সেসময় আমার কাছে নিত্যনতুন গল্প ফেঁদে টাকা চেয়ে চিঠি দিতো তথাকথিত সেই প্রেমিক। ওইটুকুন আমি মরিয়া হয়ে কান্নাকাটি জুড়তাম, এতো টাকা আমি কোথায় পাবো? এই নেশাগ্রস্ত, প্রতারক লোক আমার জীবন থেকে নয়টা মূল্যবান বছর কেড়ে নিতে সক্ষম হলো। বুঝতে পারছিলাম, আমি পারছিনা। তবু বলয় থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নেশার টাকার জন্য লোকটা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতো, গায়ে হাত তুলতো, প্রতারণার বিবিধ পথ বেছে নিতো অথচ কোনো অপরাধ না করেও সেই লোকের অপকর্ম ঢেকে রাখার তাবৎ দায়ভার যেন আমার! পরিবার আমাকে সে অশিক্ষা না দিলেও পারিপার্শ্বিকতা থেকে আমি বুঝে নিয়েছিলাম যে, সম্পর্ক ভাঙলে কেবল লোকে প্রশ্ন করে, পরিবার সমেত দোষারোপ করে। তাই নিজের চাইতে একটা ভুল সম্পর্ক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। ‘সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি’ অনেক বড় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আমার ওইটুকু বয়সে। এর বাইরে কিছু ভাবতে পারতাম না৷ এর ভারও আমি বইতে পারছিলাম না। নানা ঘটনা দুর্ঘটনার পর এই বিপন্ন জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করেতে পেরেছিলাম। ততোদিনে আমি, আমার লেখাপড়া সব বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। প্রাণটা নিয়ে বেঁচেছিলাম কোনোমতে। আমার মা – বাবা, বোনেরা, জীবনসঙ্গী, আমার কন্যাদ্বয় এবং শ্বশুরালয় থেকে এ নিয়ে দ্বিতীয় কথা না থাকলেও অন্যান্য লোক আছে যারা সুযোগ পেলে এই সম্পর্ক নিয়ে আজো দু’ কথা বলতে ছাড়ে না। সেসব কথা নিয়ে পড়ে থাকলে আমার আর বাঁচা হতো না।

নিজের গুরুত্ব নিজে অনুধাবন না করলে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় থাকে না আসলে৷ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কিসের এতো দায় একলা মেয়ের?
প্রেম হোক বা বিয়ে, জীবন উজাড় করে সম্পর্ক ধরে রাখার এই প্রথা বা প্রবণতা এক কথায় অসুস্থ ও প্রাণঘাতী। সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হলে সে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলার শতভাগ অধিকার নারী – পুরুষ নির্বিশেষে একজন মানুষের আছে। প্রতারক কখনো প্রেমিক হতে পারে না আর যে স্বামীত্ব ফলায় সে জীবনসঙ্গী হয় না। অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ককে জীবন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করার মধ্যে কোনো দোষ থাকতে পারে না। আরোপিত যাতাকল থেকে আমাদের মেয়েদের মনের মুক্তি মিলুক।
এই বসন্তদিনে ভুল মানুষকে ফুল দিয়ে নয়, প্রেম আসুক শিমুল – পলাশ – কৃষ্ণচূড়ার বিপ্লব নিয়ে।
লোকলজ্জা, সমাজের ভ্রুকুটি, রক্তচক্ষু আর ঘেরাটোপের আগল ভেঙে নিজের স্বাধীন সত্তাকে শ্রদ্ধার ব্রত নিয়ে ‘রচি মম ফাল্গুনী’।

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: লেখক ও শিল্পী

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *