কীভাবে আমার ছেলেকে ‘পুরুষ’ নয়, মানুষ করে গড়ছি!
শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা।। যেদিন প্রথম আমি জানতে পারলাম, আমার ভেতরে বেড়ে ওঠা প্রাণটা লিঙ্গে পুরুষ, সেদিন থেকে আমার মনের মধ্যে নানা ধরনের কৌতুহল, প্রশ্ন, ভয় ইত্যাদি জন্ম নিতে শুরু করেছিল।
কারণ দুই বোন হওয়ার কারণে একটা ছেলে শিশুর বেড়ে ওঠা কেমন হয়, তা জানা ছিল না আমার। আমি বুঝতাম না ছেলেদের ভাবনার জগৎটা কেমন, জানতাম না ছেলেরা কীভাবে বড় হয়!
সেই সময় থেকেই আমি আশপাশের কিশোরদের মানে যারা বয়ঃসন্ধিতে পড়েছে তাদের আচরণ লক্ষ্য করতে শুরু করি। মানে ওরা কীভাবে কথা বলে, কী নিয়ে কথা বলে, কীভাবে দাঁড়ায়, কীভাবে হাসে ইত্যাদি।
বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, এইটুক এইটুক ছেলেদের মধ্যে আমি যে প্রবল পৌরুষ দেখেছি, তাতে রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি আমি। বারবার এটা ভেবে বিচলিত হই যে, সমাজে পুরুষদের জন্য যে সুবিধা ছড়ানো আছে, তার ভেতর আমার সন্তানটিকে আমি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো তো?
শুরু থেকেই আমাদের ভাবনা ছিল, আমাদের ছেলেকে যেন মানুষ হিসেবে বড় করতে পারি।
তবে এই বাংলাদেশে বসে সেইটা যে মোটেও সহজ কাজ না, তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। যেমন, আমার ছেলের গায়ের রঙ সাদা, এটা তার জিনগত বৈশিষ্ট্য। এখানে আমাদের কারো হাত নেই। অথচ তার সেই একমাস বয়স থেকে আমাকে শুনতে হয়েছে, ‘নীরা, তোমার ছেলের বৌ তো কালো হবে। ফর্সা ছেলেরা কালো বৌ পায়।’
আমি বলি, ‘আমার ছেলে যদি বড় হয়ে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কারো গায়ের রং বিবেচনায় না নিয়ে মন বিবেচনায় নিতে পারে, তাহলে আমি গর্বিত বোধ করবো।’
আবার যেমন ও কাঁদলে কেউ কেউ বলেন, `ছিঃ, ছেলে মানুষ কাঁদে নাকি?’
তাদেরকেও থামিয়ে দিতে হয়। বলি, ‘কষ্ট পেলে, ব্যাথা পেলে, দুঃখ পেলে যে কেউ কাঁদতে পারে। কান্নার কোনো জেন্ডার সেনসিটিভিটি নেই।’
এমন আরও অনেক কিছু।
এখন আমার ছেলের বয়স তিন বছর। ওকে আমি সব রঙ পরাই। গোলাপি, লাল, কমলা, বেগুনি সব। বরং চেষ্টা করি যেন নীল কিছু কিনতে না হয়। যেন ‘ছেলেদের রঙ নীল’ এই কথা যেন ওর জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হয়।
আমার ছেলের বেশিরভাগ খেলনা উপহার পাওয়া। কিন্তু যেহেতু ও ছেলে, তাই কেউ ওকে হাঁড়ি-পাতিলের সেট কিনে দেয় না। কিন্তু আমি দিয়েছি। গোলাপি রঙের চমৎকার একটি হাঁড়ি-পাতিলের সেট। সেই সেট নিয়ে সে খেলা করে। চুলার ওপর হাঁড়ি বসিয়ে চামচ দিয়ে নেড়ে রান্না করে। মিছিমিছি রান্না করা সেই খাবার, কখনো চা আমাদের পরিবেশন করে। আমরাও মিছিমিছি খেয়ে ওকে উৎসাহ দিই।
রান্না যেহেতু সব মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই শেখা প্রয়োজন, তাই রান্না শুধু মেয়েদের কাজ এই কথা যেন আমার ছেলে না শেখে, তাই এই চেষ্টা। আমার অনেক সহকর্মীদের দেখি, যারা রান্না করতে পারে না বলে রোজ রেস্টুরেন্টের খাবার খায়, আর অ্যাসিডিটিতে ভোগে। দুই বেলা গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট খাবে, কিন্তু দুটো ডাল-ভাত সেদ্ধ করে একটা ডিম ভেজে নেবে না। এ কেমন মেল ইগো রে বাবা, যে ইগোতে নিজেরই পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়!
আমার উজানও নিশ্চয়ই একদিন বাড়ির বাইরে যাবে, পড়তে কিংবা চাকরি করতে। হয়ত তার জীবনসঙ্গীও বাড়ির বাইরে কাজ করবে। তখন নিশ্চয়ই সেই মেয়েটা অফিস করে এসে একা ভাত চড়াবে না। দুজনে মিলে রান্না করবে, উজান সকালে ওর স্ত্রীর জন্য নাশতা বানাবে, রান্না করবে, কেক বানিয়ে সারপ্রাইজ দেবে, আমি কিন্তু এমন স্বপ্নই দেখি।
প্রতিদিন বিকেলে আমাদের বাসায় একজন গৃহসহকারি আসেন রান্না করতে। প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে রুটি বানাতে বসে যায় আমার ছেলে। আমরা মানা করি না। আমি চাই ও রুটি বানাতে শিখুক। কারণ আমি নিজে জিনিসটা ভালো পারি না। নাহয় ছেলের তৈরি রুটিই খেলাম।
ও যখন থেকে কমান্ড বুঝতে পারে তখন থেকেই ডায়াপার পরিবর্তনের পরে নিজের ডায়পার ময়লার ঝুড়িতে ওকে দিয়েই ফেলাই। আবার পোশাক পরিবর্তনের পর নোংরা পোশাকটি নিয়ে নির্দিষ্ট ঝুড়িতেও সে রেখে আসে। ইদানিং তাকে দিয়ে টুকটাক বাসার কাজও করানো হয়। যেমন তার নানীর হাঁটার লাঠি এনে দেওয়া, চা খাওয়া শেষে কাপটা রান্নাঘরে রেখে আসা, নানা বাজার নিয়ে ফিরলে কিছু জিনিস নানীর কাছে পৌঁছে দেওয়া, এলোমেলো খেলনা গুছিয়ে রাখা, বই-খাতা গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি।
আমি নিজে খুবই ছন্নছাড়া মানুষ। মানে সংসারী বলতে যে চিত্র সমাজের চোখে ভাসে, আমি তার ঠিক উল্টো। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিলাম, তখন দেখা যেত চেয়ারের ওপর ছেড়ে রাখা কাপড় জমছে তো জমছেই। যতক্ষণ না কাপড়ের ভারে চেয়ার উল্টে যাচ্ছে ততক্ষণ জমতো। তারপর মন চাইলে একদিন সব গুছিয়ে ঝকঝকা করে ফেলতাম।
আমার আম্মু খুব বিরক্ত হয় এসব কারণে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, এর জন্য আসলে আম্মুই দায়ী। সারাটা জীবন কোনো কাজ করতে দেয়নি। শুধু পড়া আর পড়া। পড়লে আপত্তি নেই, তা সে গল্পের বইও হোক না কেন। কিন্তু পড়তে হবে, প্রাইভেট পড়তে যেতে হবে, বাসায় টিউটর আসবেন, ছবি আঁকা শেখাতে শিক্ষক আসবেন, কারাতের ক্লাসে যাবো। কিন্তু বাসার কোনো কাজ করবো না। তাতে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে। আমি বোধহয় চা বানাতেও শিখেছি স্কুল পেরোনোর পর।
এখন হুট করে যদি বলা হয় কাজ করো, সংসারী হয়ে যাও, তাহলে সেটা সম্ভব?
তাই উজানকে আমরা এখন থেকেই গোছগাছের শিক্ষা দিচ্ছি। সে নিজের বই গুছিয়ে রাখে। আমরা বাড়ি ফিরলে আমাদের জুতো নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে, এক টুকরো কাপড় পেলে ফার্নিচার মুছতে লেগে যায়।
আপনারা ভাবতে পারেন, উজানের স্বভাব-চরিত্র কী ‘মেয়েদের মতো’ হয়ে যাচ্ছে?
জবাবে বলি, বাসার কাজ করলে কেউ মেয়েদের মতো হয় না। বাসায় যেহেতু ছেলে-মেয়ে সবাই থাকে, সেহেতু সবাই কাজ করা উচিত। শুধু পড়ালেখা করলে অবস্থা আমার মতো হবে। নিজের কাজটুকুও করতে শিখবে না।
ওকে সবসময় মারামারিতে নিরুৎসাহিত করি আমরা। এখন পর্যন্ত কোনোদিন বন্দুক নিয়ে খেলতে দিইনি। হ্যাঁ, যদি সে কোনোদিন সামরিক বাহিনীতে বা পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয় তাহলে অস্ত্র চালনা এমনিতেই শিখে যাবে। কিন্তু সেজন্য শিশুকাল থেকে হাতে বন্দুক দিতে হবে বলে আমি মনে করি না। আমাদের মনে হয়েছে, বন্দুক দিয়ে খেললে সে হয়ত হিংস্রতার প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠতে পারে।
তবে দুঃখের বিষয় হলো, টেলিভিশন দেখে বা কার্টুন দেখে সে বন্দুক চিনেছে। এখন মাঝে মাঝে হাত দিয়ে গুলি করার ভঙ্গি করে, আমাদের গুলি করতে চায়। তখন আমরা বোঝাই যে, শুধু শুধু কাউকে গুলি করতে হয় না, এটা ভালো না।
খেলনা পুতুলগুলোকে নিজের বেবি পরিচয় দেয় সে। তাদের ঘুম পাড়ায়, খাওয়ায়। আমরা কখনো বাধা দিই না। কারণ ও দেখেছে যে, ওকে ফিডার বানিয়ে খাওয়ায় ওর বাবা, ওকে ভাত খাওয়ায় ওর বাবা। তাই এসব ওর জন্য অস্বাভাবিক কিছু না।
আমার ছেলে এরই মধ্যে কমপ্লিমেন্ট দিতে শিখেছে। আমি শাড়ি পরে সাজগোজ করলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘আম্মা তোমাকে সুন্দর লাগছে।’
আমি খুশি হই, মনে মনে বলি, বড় হয়ে কোনো সঙ্গী হলে তাকেও এমন কমপ্লিমেন্ট দিও বাবা, তাকেও সমান গুরুত্ব দিও, তাকে সম্মান দিও।
জানি না, কতটুকু স্বপ্ন পূরণ হবে। কতটুকু মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো ছেলেটাকে। তবে আমাদের শতভাগ চেষ্টা থাকবে ওকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। সেই মানুষ, যে নারীদের সম্মান করবে, যে দুর্বলের ওপর চেপে বসবে না, যে অনুমতি ছাড়া কোনো নারীর শরীরে হাত দেবে না, যে নারী-পুরুষে ভেদাভেদ করবে না, যার হৃদয় হবে ভালোবাসায় পূর্ণ।
আপাতত ছেলেটাকে মানুষ হিসেবে বড় করার লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগোচ্ছি। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।
শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা: সাংবাদিক