শালিকের দুঃখ
ক্যামেলিয়া আলম।।
২০১৯ সালে ইতিহাসের পাতায় অনুল্লেখযোগ্য একটি দিন। ২০ ফেব্রুয়ারি।
সময় সকাল ১০টা
মৃন্ময়ীর ঘুম ভাঙে। আয়েশী এক সময় কাটাবার পরিকল্পনা নিয়ে গতরাতে প্রায় সারারাতই কথা বলেছে প্রতুলের সাথে। কী যে ছাইপাশ গিলে আর মনপ্রাণ উজার করে প্রেমে ভাসায়! এক অদ্ভুত আচরণ প্রতুলের থেকে পায় ইদানীং মৃন্ময়ী। এলকোহলে মোড়ানো প্রতুল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বড় বেশি কাছের। স্বাভাবিক সময়ে সামান্যতেই ধমক ধামক আর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের চুড়ান্ত চেষ্টা করে। অধিকাংশ সময়েই খুব সামলে কথা বলতে হয় ওর সাথে, কোন বিষয় নিয়ে তর্ক করতে গেলেই হুট করে প্রতুলের বদলে ডায়ালের পি পি শোনা। ঘুম থেকে উঠেই মৃন্ময়ীর এই সব বিচ্ছিরি ভাবনাগুলো একনাগাড়ে মনের জগতে এসে ভিড় করে। মৃন্ময়ী চোখ বন্ধ করে জোড়ে শ্বাস নেয়। অলিন্দের চোরাকুঠুরি থেকে ময়লা চিন্তাগুলো উগড়ে দেবার আশায়। মোবাইল খুলে সার্গের মিউজিক ছাড়ে।
সময় সকাল ১১. ১৭
মোবাইল বেজে উঠলে মৃন্ময়ী ফোন ধরে। অপর প্রান্ত থেকে শান্তর কন্ঠস্বর।
হ্যালো, বল শান্ত
এই তুই জানিস, চকবাজারে ভয়াবহ আগুন লেগেছে।
তাই নাকি? জানি নারে
টিভি তে দেখাচ্ছে তো। আহারে, এতো যানজট আর চাপা গলি যে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঠিকমতো ঢুকতে পারছে না
ফোনটা হাতে নিয়ে মৃন্ময়ী টিভি ছাড়ে। লোকে লোকারণ্য। রিপোর্টারের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর। আর টিভি ক্যামেরায় প্রজ্জ্বলিত চকবাজারের দৃশ্যের সাথে আরও কিছু দৃশ্য মৃন্ময়ীর চক্ষুগোচর হল। হাসিমুখে উঁকি ঝুকি দিয়ে টিভি ক্যামেরাতে নিজের চেহারা দেখাবার চেষ্টা, ক্যামেরার একটু দূরে অবস্থানকারীর ভি চিহ্নিত আঙুল, মোবাইল হাতে আগুনের দৃশ্যকে ধারণ করার চেষ্টা ও এমন বিরল পুড়ে যাবার দৃশ্যের রমরমা সাক্ষ্য হিসেবে নিজেকে গর্বিত করবার সেলফি তোলার চেষ্টা।
ইশ! কী হচ্ছে এগুলো। এই ভীড়ে কাজ করবে কী করে? হায় হায়। ওকে শান্ত রাখি রে
সময় সকাল ১১. ২৯
মৃন্ময়ী প্রতুলকে ফোন দেয়। প্রতুলের স্বাভাবিক কন্ঠকে ছাপিয়ে মৃন্ময়ী উত্তেজিত কন্ঠে বলে
প্রতুল, তুমি জানো, চকবাজারে ভয়ংকর আগুন লেগেছে
হুম, জানি
আহারে! কি একটা অবস্থা ঢাকা শহরের। একদিকে যানজট আরেকদিকে মানুষগুলোর কান্ডজ্ঞানগুলো দেখছো?
হুম! অসভ্য আর বর্বর সব, ফেইসবুকে যে কয়টাকে আজ আগুনের সাথে সেলফি দেখবো, সাথে সাথেই ব্লক করবো
প্রতুল, এমন কেন হয়ে যাচ্ছি বলতো!
কেমন হচ্ছো?
এই যে কারও বেদনা আর বিষাদ কারও মনে রেখাপাত করে না
আচ্ছা
তোমার খারাপ লাগছে না
না
থমকায় মৃন্ময়ী।
ধুর! ফাজলামো কর না তো, কী যে খারাপ লাগছে। একই শহরে একদল জ্বলছে আর আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখছি, কিছুই করতে পারছি না
কী করতে চাও?
এভাবে কথা বলছো কেন আশ্চর্য! তোমার নিজের ঠিকই খারাপ লাগছে, জানি আমি।
না লাগে না। এখন রাখো তো, কাজের সময় ফোন দিয়ে এসব মায়াকান্না শুনিও না তো , রাখলাম
সময় দুপুর ১২. ১০
মৃন্ময়ী উঠে টিভি বন্ধ করে নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকে। ভাবতে থাকে। আসলে মায়াকান্নাই তো। এক জলজ্যান্ত শরীর পুড়ে ছাই হচ্ছে কারও, এক ফোটা বাতাসের জন্য হাসফাস করছে কারও ফুসফুস, এই তীব্রতার কাছে পৌঁছানো সহজ তো না! তবু মৃন্ময়ীর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। চোখ ভিজে উঠে। প্রাকৃতিক কোন শক্তির কাছে পুড়তে থাকা মানুষগুলোর দ্রুত মৃত্যু কামনা করে। ভয়ংকর রাগ লাগে, অসহায় লাগে। বোঝে যে, এমন এক দেশের মানুষ হয়ে জন্মাবার শোধ জ্বলতে জ্বলতেই দিতে হয়। সিরিয়ার এক শরণার্থী বাচ্চার প্রচন্ড শীতে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চেহারা ঠিক এই সময়েই মাথায় আসে। হাঁটু থেকে পা অবধি সাদা পাগুলো নীলচে হয়ে গেছে, গায়ে কেবল এক লাল হাতাওয়ালা পশমী জামা, সোনালী চুলগুলো আলুথালু বেণি, ওর চোখ আর মুখের সেই তীব্র কষ্টের চাহণী মৃন্ময়ীকে বেশ কয়েক রাত ঘুমাতে দেয়নি তখন। পরে নিজের স্বার্থের দৌড়াদৌড়ি সেই চেহারাকে আড়ালও তো করেছে! মৃন্ময়ী বোঝে যে আর বেশি সময় ঘরে একা পড়ে থাকলে শ্বাসকষ্ট শুরু হবে এবার। ঠিক করে প্রতুলের সাথে অফিসে গিয়েই দেখা করবে। কিন্তু সেই সন্ধ্যা সাতটা।
সময় বিকেল ৪. ০২
মৃন্ময়ী বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। হাটতে থাকে। আগের মতোই চলছে ব্যস্ত নগরী। কেবল মানুষের মুখে আহারে, উহুরে এরপরেই আবার ব্যস্ত যে যার মতোন। মৃন্ময়ীও তো আলুথালু বেশে বের হয়নি। পরিপাটি পোশাক গায়ে জড়ানো। কোথায় যাবে মনস্থির করতে পারে না। একসময় মনে হয়, কোন লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে ডুবে থাকে, আরেক সময় মনে হয়, আজ কোন পড়াই মাথায় ঢুকবে না। প্রতুলের অফিসের কাছাকাছি এক শপিং মলে গিয়ে ঘুরতে থাকে। বসার একটা জায়গাও থাকে না মার্কেটগুলোয়। কী যে করে! একসময় এক দোকানে গিয়ে চোখের এক কাজল কিনে টুকটাক কথা বলে বসার অনুমতি নিয়ে বসে মোবাইল হাতে নেয়। ফেইসবুক জুড়েই নানা রকম আহাজারি, মতামত, নানা পরামর্শ দেয়া পোস্ট। পড়তে পড়তে মৃন্ময়ীও ডুবে যায় অদৃশ্য রশ্মীর ঘেরাটোপে। কখনও উত্তেজিত, কখনও ক্রোধ, ডিজিটাল সংক্রমণের মাঝেই চকবাজারের আগুন কেবল জ্বলতে থাকে মৃন্ময়ীর বুকে।
সময় বিকেল ৫. ১৭
মৃন্ময়ী এবার একবার উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে এসে কপিশপে ঢোকে। এককাপ কফি নিয়ে আয়েশ করে আবারও মোবাইল খোলে। দেখে মৃতের সংখ্যা ৭৮, ফায়ার ব্রিগেড প্রায় ৫ ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নেভাতে পেরেছে। বাতাসে এখনও কার্বন আর পোড়া গন্ধ। এর মাঝে একজন লিখেছে আসলে মারা গেছে ৫০০, কিন্তু প্রচার হতে দিচ্ছে না। এই এক মিথ্যাজালের জগত। সত্য আর মিথ্যার এই টানাটানিতে আসলই হারিয়ে যায়। সমস্যা সেই তিমিরেই পড়ে থাকে।
সময় সন্ধ্যা ৬. ০০
মৃন্ময়ী এবার ফোন দেয় প্রতুলকে। অফিসের কাছে শুনে প্রতুল জানায় তখনই দেখা করতে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে মৃন্ময়ী। অফিসমুখে ছুটতে থাকে। প্রতুল পাশে এলেই মৃন্ময়ীর জগতের সমস্ত অন্ধকার কেটে যায়। এতোটা নির্ভরশীলতা ঠিক না, বেশ ভালোই জানে মৃন্ময়ী। কিন্তু পোড়ার মন কি বোঝে তা? প্রতুলকে ঘিরে মৃন্ময়ীর এই সতেজ বাতাস ভালোই টের পায় প্রতুল। মৃন্ময়ী যে এক আস্থার জায়গা তা ঠিকই বোঝে প্রতুল, কিন্তু তার এই অতিমাত্রার নির্ভরতা গলা চেপে ধরার মতো লাগে প্রতুলের। মৃন্ময়ীর অতি উৎসাহকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসে প্রতুল। দিনের পর দিন রুঢ় আচরণ থেকে শুরু করে ফেইক আইডির মাধ্যমে প্রেমালাপের চেষ্টাকে রীতিমতো খেলা হিসেবে নিয়েছে। ভিন্ন আইডি থেকে কথপোকথনকালে মৃন্ময়ীর রাগ রাগ কথা যে কত দিনের হাসির খোরাক যুগিয়েছে প্রতুলের।
সময় সন্ধ্যা ৭ টা
মৃন্ময়ীর মুখ ভার। প্রতুলকে ছাড়তে চাইছে না। আর প্রতুলও কাজের চাপ, অমুক তমুক বলেই যাচ্ছে।
না, প্রতিবারের মতোন রাত দশটা অবধি থাকবো। এরপর একসাথে রাতে খাবো, তারপর বাসায় ফিরবো।
তুমি না খুব জ্বালাও, আজ বলে আসোনি কেন? কাজের চাপের দিন এসে হুট করে হাজির হয়ে যাও!
মোটেই কাজের চাপ না, আমি জানি।
প্রতুলের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। তবু মৃন্ময়ী আকঁড়েই থাকে।
আমার আজ মনটা সত্যিই খারাপ, তুমি নাহয় কাজ সেরে আসো, আমি বসি, একসাথে ফিরবো আজ
সময় রাত ৮.৪৫
রাস্তার এক গোল চক্বরে মৃন্ময়ী বসে ভাবতে থাকে। কেন সে এমন পাগলামো করে। প্রতুলকে আকঁড়ে থাকবার ইচ্ছে কি প্রেম, নাকি জেদ নাকি আশংকা? প্রতুল মিথ্যা কাজের কথা বলে অন্য কারও সাথে দেখা করতে যাবে না তো? এতো খারাপ ব্যবহার কেন করতে থাকে সবসময়ই? প্রতুলের জন্য মৃন্ময়ী এতো এভেইলেবল হওয়াকে আর যাই হোক ব্যক্তিত্ব যে বলে না সেও বোঝে। তবু কেন এমন করে? ওকে ভালোওবাসে, অথচ বিশ্বাসও করতে পারে না কেন পুরোপুরি? আর বিশ্বাস যাকে পুরো করতে পারে না, তাকে কেন পাগলের মতো ভালবাসবে? এই জটিল ধাঁধার উত্তর হাতড়ে বেড়ায় মনের অলিগলি পথে। তবু পুনরাবৃত্তির দিনযাপন।
সময় রাত ৮. ৫৬
প্রতুলের ফোন আসে। মৃন্ময়ী তড়িঘড়ি করে ধরে।
তুমি কই?
গোলচক্বরে
ওকে, রাস্তায় পার হয়ে এসে দাঁড়াও
মৃন্ময়ী পড়িমরি করে ছুটে রাস্তা পার হয়। সিগন্যালের কাছাকাছি দাঁড়াবার মিনিট পাঁচেক পর এক গাড়ি এসে থামে। মৃন্ময়ীর সন্দেহই ঠিক, কাজ মাজ কিছু না। আসলে প্রতুলের বন্ধু ইমরান এসেছে। প্রতুল গাড়ির পেছনে বসা, ড্রাইভারের পাশে ইমরান। গাড়িতে উঠতে বলে। মৃন্ময়ী গাড়িতে উঠে বসেই বোঝে দুই বন্ধু ড্রিংক করেছে। নেশাতুর হাত মৃন্ময়ীকে হেচঁকা টানে নিয়ে বসায়। ইমরানের সামনে কিছুটা অস্বস্তি হয়ে আবার সরে বসে। নেশাতুর চোখে ইমরান হাত বাড়ায় হ্যান্ডশেকের জন্য। কেন যেন মৃন্ময়ীর মন সায় দেয় না। মৃন্ময়ী না দেখার ভান করে সালাম দিয়ে পিছিয়ে সিটে বসে। ইমরান স্থিরতা নিয়ে তীর্যক দৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে তাঁকিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়ে সামলে বলে,
ভালো আছেন?
জ্বি ভাই, ভালো, আপনারা একসাথে জানলে আমি শুধুশুধু বিরক্ত করতাম না, ও একবারও বলেনি আপনি এসেছেন।
আপনার প্রেমিক আমারে তার অফিসের সিড়িগোড়ায় ঠাঁয় দাড় করিয়ে রেখেছে পয়ত্রিশ মিনিট
মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ প্রায় চারঘন্টা মৃন্ময়ী প্রতুলের জন্য অপেক্ষায় ছিলো। আর আরেক কারণেও মৃন্ময়ীর মন দমে গেলো। চকবাজারে এখনও পোড়া গন্ধ। অথচ বনানীতে তাঁর আচঁও পড়লো না। মানুষ কত স্বাভাবিক জীবনে থাকতে পারছে। মৃন্ময়ী কেন পারে না, পারছে না! চকবাজারের আগুনের তাপ কেন মনে সামান্য উত্তাপও ছড়াতে পারলো না প্রতুলের? প্রতুলের উপর এক ক্ষুব্ধতা তৈরি হয়, অভিমান জড়ো হয় এই ভেবে, হাড়ে হাড়ে চিনতে পারা মৃন্ময়ীর এই গভীর বেদনাকে উপেক্ষা করার। এরপরেও প্রতুলই মৃন্ময়ীর সব। নেশার ঘোরে চপল আচরণে মেতে ওঠে প্রতুল। মৃন্ময়ীর হাত স্পর্শ করতেই টের পায় প্রতুলের কামার্ত স্পর্শ। অভিমানের পরেও প্রতুলের গা ঘেষে বসে থাকার মাঝেও স্বস্তি পায় মৃন্ময়ী। প্রতুল যেন বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্বাস প্রবাহের একমাত্র দ্বার! এই ভালো থাকার শেষ কোথায় জানে না মৃন্ময়ী। কেবল প্রতুলের সান্নিধ্যকে প্রবলভাবে উপলব্ধি করে। গাড়ি বনানী লেক অবধি ঘুরে আবার গোলচক্বরের কাছে ফিরে আসে। এরপর মৃন্ময়ীর বাড়িমুখো হয়ে বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দেবার আগে মৃন্ময়ীকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে। রাস্তায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে মৃন্ময়ী ওদের গাড়িটি চলে যেতে দেখে। গাড়ির বিন্দুটি মিলিয়ে যাবার পর বাসার দিকে পা বাড়ায়।
সময় রাত ১০. ৪০
প্রতুলের ফোন আসে মৃন্ময়ীর কাছে। মৃন্ময়ী জানে, আজও প্রায় সারারাতেই একটু পর পরই কল আসবে। যত বেশি মাতাল হতে থাকে ততই মৃন্ময়ীর পাশে চলে আসে প্রতুল। একের পর এক কথা বকেই যেতে থাকে। মৃন্ময়ী জানে যে পরেরদিন সকালেই সব ভুলে যাবে। তবু কানে ফোনটা ধরে রাখে। ওর এই নেশার ভালোবাসার প্রতিটি মিথ্যাকেই তখন সত্য বলে মনে হয়, ভালো লাগায় ডুবে যেতে যেতে রাত্রি পাড়ি দেয়াও হয় রাতের পর রাত। কথা জড়িয়ে মৃন্ময়ীকে বলতে থাকে,
ইউ আর মাই লাভ, আমার ভালোবাসা, তুই আমার কাছে কী চাস?
এরপরই শুরু হয় প্রতুলের জীবন দর্শন নিয়ে মতামত। একের পর এক কথা বলতে থাকে। এরমাঝে সামান্য এক শোরগোলের শব্দ শোনা যায়। প্রতুল তড়িঘড়ি করে বলে
এই রাখো তো, পরে কল দিচ্ছি
তুমি এখনও গাড়িতে? ইমরান ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছো?
কথা শেষ করার আগেই ফোন কেটে দেয় প্রতুল। মৃন্ময়ী শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সময় রাত ১১. ৩৭
প্রতুলের ফোন আসে আবারও। এবার ভিডিও কল। ইমরান ভাইয়ের অফিসে থাকবে। অফিসের উপর ছোট এক স্যুট আছে তার। অফিসের কাজ শেষে বেশি রাত হয়ে গেলে অফিসে থাকবার এক জায়গা। মাঝেমাঝে বন্ধুবান্ধবের আড্ডা আর থাকার জায়গা। প্রতুলও অনেক সময় ড্রিংক বেশি করলে সেখানেই থেকে যায়। ভিডিও কলে প্রতুলের গোসল করা শরীর দেখতে পায়। ভেজা মুখে বেশ সতেজ দেখাচ্ছে তাকে। কন্ঠতে কামনা ঝরে ঝরে পড়ছে।
তখন কী হয়েছিলো তোমাদের?
পুলিশ ধরেছিলো
মৃন্ময়ী হাসতে থাকে।
পুলিশ কেন ধরেছিলো? মদ খেয়েছিলে বলে?
আরে না , ওই যে মেয়েটাকে দেখে সন্দেহ করে গাড়ি থামালো
মৃন্ময়ী হালকা গলায় বলে
কী বকছো? কিসের মেয়ে
আরে জান, মাই লাভ, ওই মেয়েটা উঠালো যখন
বলেই ফোন অফ করে দিয়ে এক ছবি সেনড করলো হঠাৎ। মৃন্ময়ী জানে, মদের ঘোরে প্রতুল প্রায়ই উল্টাপালটা কাজ করে। কথা বলে।
ছবিটা দেখে হিম হয়ে যায় মৃন্ময়ীর শরীর। গাড়ির জানালার যে পাশটায় মৃন্ময়ী ছিলো, সেখানটায় বেণি বাধা বড় ফুলের ছাপ দেয়া কামিজ পরা এক মেয়ে। মেয়েটার মুখ নিচু, কিন্তু বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে সে কে!
বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় মৃন্ময়ী। পাগলের মতোন ভিডিও কল করে। প্রতুল ফোনটা রিসিভ করে
এই মেয়ে কে, প্রতুল?
ঘোরে থাকলেও কিছুটা হুশ আসে।
কী হয়েছে? কোন মেয়ে?
এইমাত্র তুমি আমায় ছবি পাঠিয়েছো।
এরমাঝেই প্রতুলের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ। কিছু শব্দ গুঞ্জন, ফ্যানের বনবন করে ঘুরতে থাকা দেখবার পরেই ভিডিও কল অফ হয়ে যায়। সাথে সাথেই পাগলের মতোন কল করতে থাকে মৃন্ময়ী। ওপাশ থেকে বার দুয়েক কাটার পরে আর কল ঢোকে না। মৃন্ময়ী ফোন দেয়, প্রতুলের ফোন বন্ধ। মোমের আলো ফু দিয়ে নিভিয়ে দেবার মতোই ধপ করে নিভে যায় মৃন্ময়ীর ভেতরের সব আলো। প্রচন্ড অন্ধকারে চারপাশ দেখতে থাকে বোবা চোখে। শুধু বোঝে, পুড়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ী, পুড়ে যাচ্ছে।
২০১৯, ২১ ফেব্রুয়ারি
সময় মধ্যরাত ২. ২০
সাত তলা অন্ধকারে ঢাকা অচেনা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গোত্তা খায় খাদিজা। অচেনা পথে চলতে চলতে চেনা পথই ভুলে গেছে। ভালো কামাই হয়েছে আজ। দুই স্যারই হাত খুলে টাকা দিয়েছে। পেট শুধু জ্বলছে। সেই বিকেলে শেষ খেয়েছিলো। কাজের মাঝে খাবারের ব্যবস্থা কোনকালেই থাকে না। দুইজনের চাপে আজ একটু আহত হয়েছে বেশি, তাতে কী, প্রায় এক সপ্তাহের কামাই তো হয়ে গেলো! এই সপ্তাহটা বিশ্রাম নিয়ে বড় ক্ষেপ ধরলেই আবার সপ্তাহের আরাম। এর চেয়ে বড় স্বপ্ন আর দেখতে পারে না খাদিজা।
চকবাজারের আগুনের কাছে খাদিজার দুঃখ শালিকের দুঃখ ছাড়া আর কী! খাদিজার পুড়ে থাকা জীবনের কাছে মৃন্ময়ীর পুড়ে যাওয়া যেমন!