September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সতী নারী বনাম অসতী নারী

আফরোজ ন্যান্সি।। বিকেলে কাঁটাবনের টিউশনিটা শেষ করে ক্যাম্পাসের দিকে ফিরছি এমন সময় মেয়েটার ফোন আসলো- “আপু তুমি কি ফ্রি আছো? তোমার সাথে দেখা করতে চাই।”

কিছুটা বিরক্ত হয়ে ওকে আমার হলে চলে আসতে বললাম। অন্যের প্রেমের ঝামেলা নিজের কাঁধে টানতে ইচ্ছা করছে না আজকের এই ফুরফুরে বসন্ত বিকেলে।

সন্ধ্যায় পর মেয়েটা আসলো। চোখ ফুলে আছে, গালে থাপ্পরের দাগ স্পষ্ট। আমার সাথে দেখা হওয়ার পর প্রথম কথা যেটা বললো তা হলো, “আমাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়া যাবা? আমার কান থেকে মনে হয় রক্ত পড়তেছে।”

ঘটনা জানতে চেয়ে ওকে আর বিব্রত করতে চাইলাম না, সরাসরি নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। রাতে ওকে আমার সাথেই থেকে যেতে বললাম। হসপিটাল থেকে ফিরে ও নিজেই বললো সব। বয়ফ্রেন্ড তাকে মারে প্রায়ই। একটা দুইটা চড় থাপ্পড় না, ভয়ানক সেসব মার। এর আগেও এসব নিয়ে কথা হয়েছে এই মেয়ের সাথে। বহুবার তাকে বলেছি, কেন পড়ে আছো এই সম্পর্কে! এর পরিণতি কী!

কিন্তু এসবক্ষেত্রে বুঝিয়ে কোনো লাভ হয়না আল্টিমেটলি। কেঁদেকেটে শেষমেশ ওই সম্পর্কেই পড়ে থাকে মেয়েরা।

এর আগেও দেখছি বহুত। ঢাকায় আমার প্রথম রুমমেট যাকে পেয়েছিলাম সমাজবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রী ছিলো সে। প্রেম করতো এক মাদকাসক্ত ভ্যাগাবন্ড ছেলের সাথে। সেই ছেলে তার এটিএম কার্ড কেড়ে নিয়ে যেত, ব্যগ থেকে টাকা নিয়ে যেত জোর করে। টাকা দিতে না চাইলে রাস্তার লোকজনের সামনেই চড় থাপ্পড় মারত। রুমে ফিরে সে শুধু বালিশে মুখ গুজে কাঁদত। আমরা বুঝাতাম তাকে এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে কিন্তু সে নাকি পারবে না। পেরেছিলো সে ঠিকই কিন্তু তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতেও হয়েছে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে হতে পারে একটা শিক্ষিত আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ কেন এসব সহ্য করে পরে থাকছে দিনের পর দিন? কি লাভ ? কি স্বার্থ?

আসল ব্যাপার হলো জন্মের পর থেকে নারীকে সতীত্ব নামের এক ধরণের মগজধোলাই দেওয়া হয়। নারীকে শেখানো হয় প্রাণের চেয়েও দামি এই সতীত্ব। প্রাণ যায় যাক কিন্তু সতীত্ব যাওয়া চলবে না। এই সমাজ মেয়েদের জীবনে একজন পুরুষকেই এলাউ করে। যে মেয়ে প্রেম ভাঙে কিংবা বিয়ে ভাঙে সে চরিত্রহীন। যত ভুল মানুষের প্রেমেই সে পড়ুক না কেন, সেই প্রেমকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে হবে এবং টেনে হিচড়ে তাকে বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে পারলে এবং বুক দিয়ে সেই সংসার আঁকড়ে ধরার মধ্যেই নারী জীবনের সার্থকতা!

এক ছেলেকে চিনতাম যার একাধিক প্রেমিকা ছিল। সে খুব গর্ব নিয়ে বলে বেড়াত “আমি বললে আমার মুতও ওরা (প্রেমিকারা) খাবে”।

বিষয়টা কি আসলেই গর্বের? একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ কখনোই এমন মানুষকে ভালোবাসবে না যার মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছু নেই। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ পুরুষই স্ত্রী হিসেবে এমন মেয়েকে চায় যাকে অর্ডার করলে স্বামীর বর্জ্যও গলাধঃকরণ করবে। একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে তারা চায়না কেননা এমন একজন নারীকে হাতের পুতুল বানিয়ে, যা খুশি তাই করে পার পাওয়া যাবেনা সেটা তারা ভালো করেই জানে।

গোটা সমাজের চিত্র যখন এই তখন যদি কোনো নারী ভুল সম্পর্কটাকে ভাঙতে চায়ও পুরুষতান্ত্রিক ইগো তা মানবে কেন? তখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল থেকে শুরু করে পাবলিক শেমিং, হুমকি এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে খুন অব্দি গড়ায় এসব কেইস! এসব ক্ষেত্রে মেয়েটি চাইলেও পুলিশের আশ্রয় নিতে পারে না। যেখানে হাজবেন্ডের হাতে নির্যাতনের শিকার কোনো নারী থানায় গেলে আজেবাজে ইঙ্গিতের সম্মুখীন হতে হয় সেখানে প্রেমিকের হুমকির মুখে থানায় যাওয়ার কথা ভাবার সাহসই করে না বেশিরভাগ নারী। ফলে প্রাণের ভয়ে হোক, সম্মানের ভয়ে হোক, অসতী নারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার ভয়েই হোক বছরের পর বছর একটা ভুল সম্পর্ককে তারা টেনে নিয়ে যেতে থাকে।

তবু এই সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে কোনো নারী যখন ভুল মানুষের জীবন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয় তখন শুধু পুরুষেরাই না বরং নারীরাও ঐ নারীকে চরিত্রিহীন বলে গালি দিয়ে নিজেদের অবদমনের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অথচ একই ঘটনা যদি কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে ঘটে, কোনো পুরুষ যখন কোনো কারণে সম্পর্ক বিচ্ছেদ চায় তখন তাকে কোনো ধরনের ঝক্কি সামলাতে হয়না, উল্টো বন্ধুর আড্ডায় সে বীরদর্পে বলতে পারে “খাইয়া ছাইড়া দিছি”। অনেক নারীকে দেখি যারা বিয়ের আগের প্রেমের সম্পর্কের কথা গোপন রাখেন পুরুষ সঙ্গীটির কাছে, আবার যদি কখনো ঘুনাক্ষরেও জানাজানি হয়ে যায় তাহলে সেই নারীকে উঠতে বসতে অসতী- চরিত্রহীন বলে খোঁটা খেতে হয় শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কাছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে কোন সম্পর্ক থাকা না থাকার সব দায় যেন নারীরই, পুরুষেরা কেবল ভোগ বিলাসিতা করবে, ইচ্ছে হলে বৌ পেটাবে, ইচ্ছে হলে প্রেমিকাকে পেটাবে, আর তাদের সাত খুন মাফ। সমাজের এই হিপোক্রেসির শেষ কোথায়? নারীরা যেদিন সতী- অসতীর গোলকধাঁধা থেকে নিজেদের মগজকে মুক্ত করতে পারবে, পরিবর্তনটা সেদিনই আসবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]