মানসিক ধর্ষকদের মুখোশ টেনে খুলে দিন
নাজিয়া খান তিথি ।। ঘটনার শুরুটা খুব অদ্ভুতভাবে।
একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পর একই কমিউনিটিতে যাতায়াত থাকায় আমাকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নাই তার। শুরু হয় ফেসবুকে টুকটাক যোগাযোগ। বড়শিতে টোপ গেঁথে মাস দুয়েক অপেক্ষা করতে হয়েছিল বৈকি। প্রোফাইল ঘেটে সে বুঝে নিয়েছিল আমি সিঙ্গেল। এক বাচ্চার মা। অ্যান্ড হ্যাপিলি ডাইভোর্সড। শুরু হল টোকা দেয়া, হাই।
প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হতাম আমি। উদ্দেশ্যটুকুও না বুঝতে পারার কথা না। এরকম ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয় সো কল্ড ভদ্রলোকদেরকে চিনতে আমার খুব কষ্ট হয় না। কিন্ত কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছিল আমারো। সপ্রতিভ কথার ধার আর স্ট্রেইট কথা বলবার ধরনটুকু উপভোগ করতে শুরু করেছিলাম হয়ত।
এরপর খুব বুদ্ধির খেলা খেল্লেন তিনি। আমার টাইপ বুঝতে সময়ও নিলেন অল্প, অ্যান্ড আই নো হি ইজ স্মার্ট ইনাফ। আমি কীভাবে এরকম একজন লোকের প্রেমে পরলাম যে কিনা নিজেই নিজের বিবাহ বহির্ভূত অন্য সব সম্পর্কের গল্প আমাকে বলার চেষ্টা করত নির্লজ্জভাবে, ব্যাপারটা আমার কাছেও রহস্য।
আমাদের দেখা হল। নানাভাবে তিনি আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন “পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই”। যা আছে সবই রসায়ন। রসায়নে আমি বরাবরই কাঁচা। তাই আবেগে ভেসে গেলাম, রসায়ন নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগল সে। এভাবেই রসায়ন আর আবেগের চির অবিমিশ্রিত সমান্তরাল স্রোত একটা সময় পর্যন্ত সমান্তরালেই চলতে চলতে একসময় ফিকে হতে হতে বিলীন হয়ে গেল। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই।
সমাজে এরকম গল্প খুব একটা কম নাই আমাদের। আশেপাশে প্রায় প্রতিদিনই শুনি। আমরা মেয়েদেরকে দোষ দেই, তুমি জেনে বুঝে গেলা কেন? এখন কেঁদেকেটে কী লাভ? এমন প্ররোচনা বা তীব্র স্বার্থচিন্তার ফসলের বলি মেয়েদেরকে নিজেদের আবেগের প্রতি অনুরাগী হতে গিয়ে কাঁদতেই বা হবে কেন?
আর অন্য দিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের দোষ ধরায় ব্যস্ত সবাই, ফাকতালে পুরুষগুলি গলে বের হয়ে গিয়ে দিব্যি সংসার ধর্ম পালন করতে থাকে। বউ এর জন্য নতুন ফ্ল্যাট আর সারাদিনের জন্য ড্রাইভারসহ গাড়ি।
দিনের শেষে বাড়ি ফেরার সময় মেয়ের জন্য ড্রইং করার খাতা। সংসার বউ বাচ্চা জায়গামত রেখে এদিক সেদিক উকি ঝুঁকি দেয়া পুরুষ আমাদের চারপাশেই আছে। আমার নিজের ফ্রেন্ডলিস্টেও ছিল। ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি।
এসব উপদ্রব এভাবেই বাস্তব ও ভার্চুয়াল জীবন থেকে ঝেঁটিয়েই বিদায় করা উচিত। পরকীয়া জীবনের বাস্তবতার বাইরে নয়। কিন্ত পরকীয়া বা স্বকীয়া যাই হোক না কেন সেটাতে প্রেম থাকা চাই। প্রেম হতে হবে অনিবার্য অনুষঙ্গ। প্রেমে পড়ার অধিকার এবং যৌক্তিক বনিবণায় মিলমিশ না হলে সেখান থেকে উঠে আসার অধিকার প্রতিটি মেয়ের আছে আর সেই প্রেমে পড়া বা প্রেম থেকে উঠে আসবার প্রক্রিয়ায় মেয়েদের কষ্ট পাবারও কিছু নাই। নিজেদের দোষ দেবার তো প্রশ্নই আসে না। প্রেমহীনতায় প্রেমের ভান করে ‘টাইম পাস’ বা অন্য যে কোন চাহিদার চৌর্যবৃত্তিক বাস্তবায়ন যে করে সে ভীরু, কাপুরুষ, লম্পট ও অমানুষ। এদের ভুল ভেবে ভালবাসা অন্যায় নয়। কিন্ত এদের মুখোশ খুলে দিয়ে সমাজে ন্যাংটো করে দেয়াটা খুব জরুরি। ধর্ষক বা খুনী বা অন্যান্য নিপীড়নকারীদের মতই। এরা সকলেই মানসিক ধর্ষক। এবং ঠিক একইভাবে একই শাস্তি পাবার দাবি রাখে।
লজ্জা পাবেন না। নিজে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আবার চলা শুরু করুন। জীবনে আপনার জন্য সত্যিকার স্বার্থহীন ভালবাসা নিয়ে যে আসবে তাকে আবার অবগাহন করুন। বাকিদের ছুঁড়ে ফেলে দিন। আর মুখোশটি নিজের লায়াবিলিটি মনে না করে পূর্ণ উৎসাহে খুলে দিন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]