November 24, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

রবীন্দ্রসাহিত্যে নারী

রুদ্র ফারাবী।। বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে মাথা নেড়ে নেড়ে-

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’

কেউ আবার বাবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়েছি, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যা দান।’

তারপর আরেকটু বড়বেলায় রবিঠাকুর আসেন ফটিকের মর্মান্তিক করুণ প্রয়াণে। এভাবেই আমাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন বিভিন্নভাবে। যখন কোন অজানা ব্যথায় কাতর হয়েছি তখন চোখ বন্ধ করে ‘যদি জানতেম আমার কিসের ও ব্যথা তোমার জানাতেম’ নিজের মনে গেয়ে গেয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছি। ভালবাসার মানে খুঁজে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়েছি ‘সখী ভালবাসা কারে কয়’ গানে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনে নানা দিক থেকে এত প্রভাব বিস্তার করে রয়েছেন, যা ভাবতেই অবাক লাগে। এক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাই একশ। মানুষের জীবনের এমন কোন অনভূতি, আবেগ, সুখ-দুঃখ নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি। রবীন্দ্রনাথ বিরাজ করছেন আমাদের অন্তরে বাহিরে সর্বত্র।

মানুষের জয়গান গাওয়া এই সাহিত্যিকের অন্যতম কাজের জায়গা ছিল নারী জাগরণও। উনিশ শতকে নারীর অধিকার যখন প্রায় অকল্পনীয়, তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নারীকে তুলে এনেছেন তার লেখনীর কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন  স্বাধীনচেতা, সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ও সাহসী হিসেবে।

শাস্ত্রে মেয়েদের বলা হয় ‘পূজার্হা গৃহদীপ্তয়’। রবীন্দ্রচেতনায় নারীকে গৃহলক্ষ্মীর সম্মানে অধিষ্ঠিত দেখার চেয়ে পুরুষের হৃদয়েশ্বরীরূপে দেখার প্রবণতা বেশি। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা নারীকে তাদের কাব্য প্রেরণার অংশ করেছেন, তাদের মধ্যে আপন মানসীকে প্রত্যক্ষ করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত কেউই নারীকে আত্মস্বাতন্ত্র্যমিত করে প্রকাশ করেন নি।

রবীন্দ্রনাথ নারীকে এঁকেছেন শব্দ তুলির হরেক আঁচড়ে। কখনও সেই নারী সুখে বহুবর্ণা উজ্জ্বল, কখনও দুঃখে সাদাকালো-মলিন, কখনও বা ধূসর জীর্ণ। তবে যাই হোক না কেন, সবটুকুই তারই আবিষ্কার। সেই আবিষ্কার রবীন্দ্রমনের, রবির কিরণের ঝলকানিতে। তিনি তো বলেছেনই-

‘আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা

তুমি আমারই, তুমি আমারই মম জীবন-মরণ বিহারী।’

প্রেম-প্রকৃতি আর সুন্দরের পূজা করেও নিজের প্রথাবিরোধী লেখনীর মাধ্যমে নারীর জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ। ভারতবর্ষে যখন সংস্কার কিংবা প্রথার বাইরে যাওয়ার চিন্তা অবান্তর ছিল বলা যায়, তখনই নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবলা নারীর সবলা চরিত্র এঁকেছেন তার গল্প, কবিতা এবং উপন্যাসেও। নারী স্বাধীনতা বা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তার লেখনী রীতিমতো প্রথা ভাঙ্গার এক অন্যকরম সংগ্রাম। কবিগুরুর লেখায় উঠে আসে সাম্যের সমাজ গড়তে নারীর ক্ষমতায়নের কথা।

রবীন্দ্রনাথের গল্প নারী মুক্তির দরজা খুলেছে। নারীকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তার লেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদী রূপ তুলে এনেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্যে আমরা বেশ ক’জন নারীকে পাই যারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে আধুনিকতার প্রতীক হয়ে আলো জ্বালিয়েছেন। স্ত্রীর পত্রে মৃণাল চরিত্রে এঁকেছেন নারীর সামাজিক স্বাধীনতার কথা। যেমনটা এনেছেন, ছোটগল্প সমাপ্তির মৃন্ময়ী, ল্যাবরেটরির সোহিনী অথবা শাস্তি উপন্যাসের চন্দরা চরিত্রের মাধ্যমে।

আর শেষের কবিতায় লাবণ্য এসেছে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সমাজে নারী বন্দীর গতানুগতিক প্রথা ভাঙ্গা আধুনিক ভূমিকায়, যাকে আমরা দেখেছি মুক্ত, স্বাধীন এবং আত্মনির্ভরশীল নারী হিসেবে। প্রেমের পাশাপাশি লাবণ্যের এই পরিচয়টাই ছিল উপন্যাসের সারগর্ভ। এভাবেই রবীন্দ্র সাহিত্যের সব নায়িকাই নারী মুক্তির মশাল জ্বেলেই উদ্ভাসিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকে পূর্বসূরিদের চোখেই নারীকে দেখেন এবং পুরুষের প্রেরণা ও প্রেয়সী রূপেই আঁকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রথম দেখা যায় চোখের বালি উপন্যাসের বিনোদিনী চরিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে। বৈধব্য নারী জীবনের এক অভিশাপ, দুর্ভাগ্য বলেই ব্যাখ্যা করেছেন প্রাক্তন সাহিত্যিকরা, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রও রোহিণীর জীবনতৃষ্ণাকে সেভাবে সমর্থন করতে পারেননি।

কুন্দনন্দিনীকেও অকালে সরে যেতে হয়েছে। কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্রকে প্রলুব্ধ করেছে অথচ বিহারীর প্রেম তার উদ্দেশ্যেই ঝরে পড়েছে। বঞ্চিত নারীত্বের যন্ত্রণাকে সমবেদনাকাতর মন দিয়ে এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘জগতে আমার ভালোবাসিবার খেদ মিটাইয়া থাকি।’ অবশ্য নৌকাডুবি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ আবার সনাতন পথেই যাত্রা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রচেতনায় নারীর সর্বোত্তম পরিচয়, সে পুরুষের আত্মবিকাশের মাধ্যমে। প্রেমোপলব্ধি ছাড়া পুরুষের-জীবন যে ব্যর্থ, অসম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ তা প্রথম দেখান চোখের বালিতে তারপর গোরা, ঘরেবাইরে এবং চতুরঙ্গ উপন্যাসে তারই ক্রমবিকাশ। বিনোদিনীর ভালোবাসাই বিহারীর একপেশে জীবনের অন্ধত্ব মোচন করেছিল, কিন্তু গোরার জীবনে সুচরিতা দান অনেক বিস্তৃত। যে গোরাকে দিয়েছে নব ভারতবর্ষের চেতনা। যে নারীর স্থান গোরার জীবনে ছিল শুধু মার ঘরে সতীলক্ষ্মী গৃহিণীর আসনে, তাকে সুচরিতা প্রতিষ্ঠা করেছে ব্যক্তির হৃদয় মন্দিরে, ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী সমস্ত মঙ্গল ভাবনায়। তাই সুচরিতার হাত ধরেই গোরা তার নতুন উপলব্ধিতে উন্নীত হতে চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ‘রমণীর মন,/ সহস্র বর্ষেরই/ সাধনার ধন’ তাই বিমলার প্রেমও জয় করতে হয়েছে নিখিলেশকে অনেক যন্ত্রণার সমুদ্র পার হয়ে। বিবাহিতা স্ত্রীর প্রেম ও বিধাতার দানের মতো অনায়াসলব্ধ এবং নিষ্কণ্টক বলে সে তার মর্যাদা হারায়। তাই সন্দীপের মোহমুক্ত বিমলাকে অনেক কান্নার মূল্যে হারিয়ে পেয়েছে নিখিলেশ।

রবীন্দ্রনাথের এই নারী ভাবনা আরও সোচ্চার হয়ে ওঠে ‘রক্ত করবী’র মঞ্জরীর লালিমায়, নন্দিনীর ধানী রঙের আঁচলের ছায়ায় আচ্ছন্ন পুরো নাটক, তার সমস্ত চরিত্র। নন্দিনীর মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়েই বিশু গেয়ে উঠতে পারে, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি/ এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি।’ ‘নারী এখানে প্রাণ এবং ভালোবাসার প্রতীক, যে যন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজেতা ঘোষণা করে।