November 24, 2024
কলামফিচার ২

পারুলের বিয়ে ও বিচ্ছেদ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।। মানুষ বিয়ে করে কেন, এমন একটা প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই বলবে, বৈধ যৌন সম্পর্ক করা ও সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য। তবে বাংলাদেশের নারীরা বলবে, এক সঙ্গে সুখে শান্তিতে সারা জীবন কাটানোর জন্যই বিয়ে।

সাংবাদিক সাজিদা ইসলাম পারুলও এমনটা ভেবেছিল হয়তো এবং তার ফেসবুক দেয়ালে সেরকম উচ্ছাসও দেখেছিলাম তার বিয়ে নিয়ে। কিন্তু বিয়ের এক মাসের মাথায় তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাবে সে হয়তো কোনদিন ভাবেনি।

পারুল, সংগ্রামী মেয়ে। আমি তাকে খুব ভাল করে চিনি, জানি। নিজে লড়াই করে ভাইবোনদের বড় করছে। সে আমাদের সাংবাদিক জগতের নেত্রীও। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নির্বাচিত হয়েছিল, সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে। বিয়ের এক মাসের মাথায় তার স্বামী যুগান্তরের সাংবাদিক রেজাউল করিম প্লাবন, আরেকটি বিয়ে করতে যাচ্ছিল পারুলকে কোন কারণ না জানিয়ে আকস্মিকভাবে ডিভোর্স দিয়ে। সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে, আইনী জটিলতায় সে বিয়ে আটকানো হয়েছে।

আমাদের সমাজের প্রচলিত সাবধানবানী বলে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আর যা কিছু হোক, বিচ্ছেদ যেন না হয়। তবুও হয়। কিন্তু প্লাবন যা করেছেন পারুলের সাথে এটি ঠিক সেই অর্থে বিচ্ছেদ নয়। পারুল বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি ঠকবাজকে, পারুল ভুল করেছে। অন্যদিকে প্লাবন প্রতারণা করেছেন। প্লাবন অপরাধী। কিন্তু তবুও কি তার কিছু হবে শেষ পর্যন্ত?

বিয়ে যদিও ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু ধরে বেঁধে একে পারিবারিক ও সামাজিক করে ফেলা হয়েছে। সব জনপদেই ধর্ম সামাজিক নীতি নৈতিকতা ঠিক করেছে। বিশেষ করে বিয়েতে ধর্মের প্রভাবই সব। বয়স, লিঙ্গ, জাত, বিশ্বাস কী হওয়া চাই, স্বামী স্ত্রীর কর্তব্য এবং দায়িত্বই বা কী হওয়া উচিত সব বলে দিয়েছে ধর্ম। কঠোর সব নিয়মও করেছে ধর্ম। কিন্তু এতে করে লাভটা পুরুষের হয়েছে বেশি। বিয়ে সংক্রান্ত সামাজিক নীতি নৈতিকতার প্রায় সব কিছুতে নারীকেই করা হয়েছে সব আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। প্লাবন এক বিয়ে করার এক মাসের মাথায় আরেকটি বিয়ে করতে গিয়েছিল এবং সেই বিয়েতেও মুরুব্বীদের সমর্থন ছিল। একবারও তার পিতা মাতা প্রশ্ন করেনি এ বিষয়ে।

এরকম অসংখ্য কাহিনী আমরা নিয়মিতই দেখছি। এমনকি আমার নিজের আত্মীয়দের মাঝে এটা ঘটতে দেখেছি। মুরুব্বীদের পরামর্শে ছেলেকে আরেক বিয়ে করানো এবং  এই কাণ্ডে একজন নারীর জীবনের এমন সর্বনাশ করার আয়োজনে অন্য নারীদের সমর্থনও দেখেছি।

পারুল গোপনে বিয়ে করেছিল। আপনজনদেরও জানায়নি। কারণ প্লাবন না করেছিল। প্লাবনের ভেতর যে একটা শয়তানি ছিল, সেটা পারুল বুঝতে পারেনি। বিয়ে যে কোন কোনো চুরিচামারি না, গোপনে বিয়ে করা ঠিক হবেনা, নিজের কাছের মানুষদের এরকম পরামর্শও পারুল আমলে নেয়নি। প্লাবন বিয়ে করতে যাচ্ছে- এটা শুনে লকডাউনের মধ্যে প্লাবনের বাড়ি চিলমারি যাওয়ার পথে পারুল ডিভোর্স লেটারটি পায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে।

পারুল আর প্লাবন বিয়ে করেছে এবং ওদের বিয়ে টেকেনি। পারুল অথবা প্লাবনের যে কেউ চাইলে একসঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্ত নিতেই পারত। বিয়েবিচ্ছেদ তো আইনবহির্ভূত কিছু নয়। বিয়েবিচ্ছেদের আইন অনুযায়ী যা যা করতে হয়, সেগুলো না করে সেই সন্ধ্যায় প্লাবন আরো একটি বিয়ে করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত হয়নি পুলিশী হস্তক্ষেপে, পারুলের সাংবাদিক বন্ধুদের উদ্যোগে। তবে নিশ্চিত যে,  প্লাবন আবার বিয়ে করবে এবং সেই নারীর কপালেও কী আছে তা বলা কঠিন।

পারুল ভালবেসেই বিয়ে করেছিল এবং প্লাবনের দিক থেকেও ভালবাসার প্রকাশ ছিল। ভালবেসে করলেই বিয়ে ভাঙ্গবে না, এই ভাবনাটা ভুল। আসলে বিয়েটাকে প্রেমের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধরে নিয়েই শুরু হয় ভুলের যাত্রা। এ ধরণের প্রেমে যা হয়, সেটাই হয়েছে। পুরুষটি আসলে দখলদারিত্বে বিশ্বাসী এবং সেটি শরীরে। এই দখলদারির মানসিকতাই তাকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দেয় তার প্রেম থেকে এবং বিয়ের পর সেই স্ত্রীর থেকে। অর্থাৎ দখল কখনোই প্রেমের পরিপূরক না এবং এরকম প্রেমগুলো বিয়েতে গড়ালেও সেই বিয়েগুলো শেষ পর্যন্ত পুরুষের কাছে প্রেমের একটা শারীরিক পরিণতিই হয়ে থাকে, মানসিক অনুভূতি হয়ে উঠে না।

এই যে দখলদারির অভ্যেস, তা থেকে পুরুষ কিছুতেই নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না। মেয়েরাও যে দখল করতে চায় না, তা নয়। পছন্দের পুরুষটিকে বশে রাখার জন্যে তাকে সন্দেহ করাই হয়ে ওঠে কারো কারো বাতিক। এটা আসলে কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, একটা সামাজিক ব্যবস্থার অংশীদার আমরা সকলেই।

মানুষ হিসেবে পারুলের মর্যাদা যেভাবে হরণ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে কী আবস্থান নেবে এই সমাজ সেটা দেখার অপেক্ষায়। তবে শিক্ষিত, রোজগার করা নারীও যে চট করে কত বড় ভুল করে তার প্রমাণ পারুল। কারণ সে শুধু প্রচলিত প্রেম ভালবাসা, ঘর সংসারের কথা ভেবেছিল। যে ছেলে তার প্রেমিকাকে সমান অধিকার, সমান মর্যাদার জমিতে শিকড় গেঁড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়না, সেই গোপনে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতে পারে। প্রেমিকের চেহারাটা পারুলের কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল তখনই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]