November 10, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

চলেন, নিজেকে এবার একটু পাল্টাই!

মেজবাহ উল আজীজ।। একটা রেপ হবার পরে যখন রেপিস্টকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেন এই কাজটা সে করল, তখন সাধারণত উত্তরটা কী আসে? “মেয়েটার কাপড় চোপড় দেখেছেন? টাইট, ছোট, পা দেখা যায়, স্ট্র‍্যাপ দেখা যায়, সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্পস্ট বোঝা যায়, she was just asking for it.”

শুধু রেপিস্ট? একটা রেপের খবরের নিচে কমেন্টে  প্রকারান্তরে ভিকটিম শেইমিংয়ের কমেন্টগুলোই বেশি। মেয়ে হয়ে ছেলের মত জামা কেন, টিশার্ট কেন, শার্ট কেন, অফ শোল্ডার কেন, স্কার্ট লম্বা না কেন? রেপ নয়, মূখ্য হয়ে ওঠে ভিকটিমের সাজসজ্জা!

এইটার সমাধান কী করা যায়, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে জামাকাপড় নিয়ে এই অসুস্থ ফ্যান্টাসি চিরতরে নির্মূল হয়? কখনো আমরা ভেবে দেখেছি যে কেন এমন হয়? কী কী নিয়ামক ছেলেদের এই ধরণের আচরণের জন্য তাড়িত করে?

সেইটা নিয়ে আলোচনার আগে একটা পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স শেয়ার করি। ঢাকার এক অভিজাত এলাকার শপিং মলের বাইরে আধুনিক একটা ফার্মেসি। ওষুধ ছাড়াও সেখানে সাপ্লিমেনট হিসেবে অনেক কিছু পাওয়া যায়। প্রেসক্রিপশনের ওষুধ ছাড়া বাকি জিনিসগুলি নিজেদের শপিং কার্টে নিয়ে একবারে কাউন্টারে বিল দেয়া যায়। আমার এক ফ্রেন্ডের বিবাহবার্ষিকী,  আমি গিয়েছি তাদের জন্য উপহার হিসেবে এক কার্টন কনডম কিনতে, সাথে বৌ এর জন্য প্যাড। ঢুকে শপিং কার্ট নিয়ে কাউন্টারে কিছু না জিজ্ঞেস করেই আমি খুঁজতে শুরু করলাম। কারণ চায়না থাকতে আমি দেখেছি, এসব দোকানে এই জিনিসগুলো ইউজুয়ালি সামনেই থাকে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম পুরো শপের যতটুকু চোখ যায়, কোন র‍্যাকেই এই দুইটা নাই। একটু অবাক হয়ে কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কনডমগুলো কই ভাই?” কাউন্টারের লোক থতমত খেয়ে গেল। আমার পিছনে দুইজন কাস্টমার ছিলেন, তারাও থতমত খেলেন। কাউন্টারের লোকটা আমাকে ফিসফিস করে বলল, “স্যার, এদিকে আসেন।” আমি অবাক হয়ে তার পিছে পিছে গিয়ে দেখি দোকানের একদম কোনায় একটু অন্ধকার মত জায়গায় প্লাইউড দিয়ে একটা পার্টিশন করা, সাথে চিপা একটা দরজা, যেটা দিয়ে ঢোকাই দায়, তার ওপাশে র‍্যাকে শুধু কনডম আর প্যাড। আমি ওখানে ঢোকার সময় খেয়াল করলাম আশে পাশের সবাই আমার দিকে একটু অন্যভাবে তাকাচ্ছে, যেন আমি কোন পাপ কাজ করার জন্য পার্টিশনের আড়ালে যাচ্ছি। আমি অতটা পাত্তা না দিয়ে সোজা একটা বড় প্যাকেট কনডম আর একপ্যাকেট প্যাড নিয়ে এসে কাউন্টারে রেখে বিল জানতে চাইলাম। দোকানী বিল নেয়ার আগে শশব্যস্ত হয়ে গেল, কারণ তার ব্রাউন পেপার প্যাকেট পাচ্ছে না। ব্রাউন পেপারে প্যাকেট না করলে ব্যগের মধ্যে দেখা যাবে।  আমি একটু মুখ শক্ত করে বললাম, “ভাই ব্রাউন পেপার লাগবে না, its just condom and pad, not cocaine!”

চিন্তা করুন পাঠক, এইটা ২০২০ সাল। আমরা স্যাটেলাইট পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছি মহাকাশে। অথচ আমাদের চিন্তা চেতনাকে মহাকাশ তো দূর, ২০ তলা দালানের উপরেও পাঠাতে পারিনি। আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় কনডম একটা নিষিদ্ধ বস্তু। কনডম দেখলে সেইফ সেক্স প্র‍্যাক্টিসের বদলে আমাদের মাথায় আসে “ওরা সেক্স করসে”! প্যাড দেখলে ঠোঁটের কোনে একটা হাসির ঝিলিক খেলে যায়। আস্তে করে গিয়ে প্যাড ইউজারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে জিজ্ঞেস করি, “আপা, রোজা করতেছেন”? আমাদের শেখানো হয় নাই যে একটা মেয়ের শরীরে পিরিয়ডের সময় কী কী চেঞ্জ আসতে পারে। তাদের কী পরিমাণ কষ্ট হয়, কী পরিমাণ ব্যাথা অনুভব করে তারা! আমাদের কাঠমোল্লা টাইপের বেয়াদব হুজুরদের বয়ানে আমরা শুনি,”হায়েজ নেফাসের সময় মাইয়ারা অচ্ছ্যুৎ, নাপাক। তাগো স্পর্শে আইলে তুমিও নাপাক হইবা। এই নাপাক শরীর নিয়া নামাজ রোজা হইব না”। অথচ কেউ সুন্দর করে বলতেই পারত যে “এই কয়েকটা দিন মেয়েদের শরীরে এমন কষ্ট হয়, এই জন্য এই কয়দিন আল্লাহ মেয়েদের নামাজ রোজা থেকে ছুটি দিয়েছেন, যেন তাদের কষ্ট কম হয়। এবং এই সময়ে তাদের কষ্ট কমানোর জন্য আমাদের সাহায্য করা উচিত।”

কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুরুষদেরকে এই অসুস্থ চিন্তাধারা থেকে বের করে আনা যায়? বলিউড অভিনেতা ও স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান ভীর দাস এই ব্যাপারে একটা যুগান্তকারী আইডিয়া দিয়েছেন। এইটা সমাধানের জন্য হাইস্কুল থেকে প্রতি বছরে দুই সপ্তাহ স্পেশাল একটা কোর্স চালু করা যাক। ক্রস ড্রেসিং কোর্স। এই কোর্সে ছেলেদেরকে দুই সপ্তাহ মেয়েদের ড্রেস পরতে হবে। এমনকি ব্রা,  হাইহিল, প্যান্টি, প্যাড পর্যন্ত। যেন বড় হয়ে এই ছেলের শর্ট স্কার্ট হাইহিল পরা একটা মেয়েকে দেখে অসুস্থ যৌন আবেদনের আগে সহমর্মিতা জাগে।

“আহা রে, মেয়েটা ৫ ইঞ্চি হিল পরেছে! ইস কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! আজ তো পা টা শেষ “

অথবা

ব্রা’র নিচের অয়্যারটা নিশ্চয়ই মেয়েটাকে ব্যাথা দিচ্ছে। দাগ হয়ে কালশিটে পড়ে যাবে।”

মজার ব্যপারটা হল, বেশিরভাগ ছেলে জানেও না, যে ব্রা’র নিচে একটা অয়্যার থাকে, যেইটা মেয়েটাকে ব্যাথা দিতে পারে। তাদের কাছে ব্রা মানেই সেক্স।  অথচ ছেলেটা যদি একটা টিশার্ট পরে যেটায় লেখা “have me from my back.” অথবা “বুকা*দা” (বাংলার গঞ্জি Tee of Bengal এর, আসলেই এইটা লেখা একটা গেঞ্জি আছে) সেইটা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা হবে না, কারণ এইটা ছেলেরা পরলেই আর্ট পিস, মেয়েরা পরলেই প্রভোকিং।

মা দিবসে চলেন নিজেকে একটু পাল্টাই এবার। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখি। মায়ের জাত, বোনের জাত, বৌ এর জাত এর আগে মানুষ ভাবতে শিখি। নিজেরাও মানুষ হয়ে উঠি।

সব মানুষকে মা দিবসের শুভেচ্ছা।

 

মেজবাহ উল আজীজ: ফটোগ্রাফার, ব্লগার ও ডেন্টিস্ট

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]