September 20, 2024
কলামফিচার ৩

ঘরের কাজ মানে ‘বউ’য়ের কাজ?

সাবিরা নুপুর।। যে কোন দূর্যোগে, সেটা প্রাকৃতিক হতে পারে বা মানুষের তৈরি; নারী এবং শিশুরা বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয় বেশি। দূর্যোগকালীন নারী এবং মেয়ে শিশুরা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কোভিড-১৯ এ এর ব্যতিক্রম হয় নাই। পাশাপাশি রয়েছে অনুৎপাদনশীল কাজের চাপ। সংসারের সব কাজের দায়িত্ব নারী ও পরিবারের কন্যা শিশুর উপর গিয়ে পড়ে । সকলেই ভাবেন ঘরের সকল কাজের দায়িত্ব শুধুমাত্র নারী ও মেয়ে শিশুর।

ঘরে আমার অবস্থানের আজ ৬০তম দিন। এই ৬০ দিনে আমাকে ঘরের কাজের পাশাপাশি অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ঘরের কাজে আমাদের পরিবারের সবাই ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু তারা সেটা করছে পরিবারে তাঁদের দায়িত্ব মনে করে না, বরং তারা ভাবছে, আমার কাজে তারা সহযোগিতা করছে। প্রতিদিনকার রান্নার তালিকা কী হবে সেটা আমাকেই নির্ধারণ করতে হয়। আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রতিদিনের রান্নার তালিকা তৈরি করা এই পৃথিবীর জটিলতম এবং একঘেয়েমি কাজ, যেটা কখনো কখনো খুবই ক্লান্তিকর। তবে আমাকে সহযোগিতার নামে করলেও পরিবারের সকলের কারণে ঘরে অবস্থানকালীন সময়টা ভালো কাটছে। আমি ভেবেছিলাম এই সময়ে সব পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই পরিবারে কিছু না কিছু ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। আমি কেন ভেবেছিলাম যে পুরুষ সঙ্গীরা তাদের পরিবারের কাজে ভূমিকা রাখবেন, সেটাও বুঝতে পারছি না।

এই ঘরে অবস্থানকালীন অনেক নারীর সাথে কথা হয়েছে, তার মধ্যে পরিবারের সদস্য আছেন, আত্মীয় আছেন, নারী সহকর্মী আছেন। তাদের বেশিরভাগই বলেছেন, বাড়িতে এই সময়টা ভালো কাটছে না। বাড়িতে পুরুষ সঙ্গীর পর্যাপ্ত সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টা আছে।

পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই মনে করেন, ঘরের কাজ মানে বউয়ের কাজ। অতএব ঘর পরিস্কার থেকে আরম্ভ করে সদস্যদের শারীরিক (যদি অসুস্থ কেউ থাকে) ও মানসিক সেবা তাকেই দিতে হবে। এটি হাস্যকর এবং একইসাথে ক্লান্তিকর। বলতে চাই ঘরের কাজ শুধুমাত্র বউয়ের কাজ না, ঘরে বসবাসরত সব সদস্যের কাজ।

কয়েকদিন আগে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপের উপাত্ত দেখছিলাম। এই জরিপ বলছে, শুধুমাত্র এপ্রিলেই ৪,২৪৯ জন নারী গৃহসহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৬৭২ জন নারী এই লকডাউনের  সময়ে প্রথমবারের মত সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু এর বাইরেও অনেক নারী ও মেয়ে শিশু আছেন যারা রিপোর্ট করতে পারছেন না বা জানেন না কোথায় কীভাবে রিপোর্ট করতে হয় বা হবে। এই লকডাউন সেই সকল নারী বা মেয়ে শিশুর জন্য বিভীষিকা হয়ে এসেছে যাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অফিসের বা ব্যবসার কাজে বাইরে থাকাকালীন সময়টুকু তারা নিশ্বাস নিতে পারতেন। কিন্তু এখন তাদের সেই পুরুষ সঙ্গীর সাথে ২৪ ঘন্টাই বসবাস করতে হচ্ছে। এই নতুন স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হতে সময় লাগার কারণে অনেকেই মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠছেন। অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের পরিবারে খাবারের অভাবের কারণেও সেই সব পরিবারের নারী এবং শিশুরা গৃহসহিংসতার শিকার হচ্ছেন। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এর বাইরে গত দুই মাসে ৩১ জন মেয়ে শিশুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই সংখ্যাটি বাড়তে পারে। ইউএনএফপিএ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী ১৩ মিলিয়ন শিশুর বাল্যবিবাহ হতে পারে যার মধ্যে বাংলাদেশের শিশুরাও রয়েছে। এবং আমরা জানি মেয়ে শিশুরা এর শিকার হবে বেশি। মেয়ে শিশুর প্রতি শারীরিক ও যৌন নির্যাতনও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনই এই বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সামাজিক মাধ্যমগুলিতে গত কয়েকদিন দেখছিলাম অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্য ঘরে অবস্থানকালীন তাদের নারী সঙ্গী বা নারীদের নিয়ে নানা ব্যঙ্গ করছে, যা নারীর জন্য অসম্মানজনক। কিছু এখানে তুলে ধরলাম:

‘‘ইতিহাস সাক্ষী থাকবে ২০২০ এ বিবাহিত পুরুষেরা ঘরে বসে একলাই দু’দুটো ভাইরাসের সাথে লড়াই করছে। এক করোনা দুই ললনা”।

‘‘আমি একটু বউএর কাজে সহযোগিতা কইরা দিছি”।

”বউরা এত কথা ক্যান কয়!”

‘‘মোবাইলে ম্যাসেজ এলো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেড় হাজার টাকা জমা পড়ছে। চিন্তার বিষয় কীসের টাকা? কে পাঠালো? স্যালারি আগেই ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছে- সে ম্যাসেজ তো মোবাইলে আগেই এসেছে। এই দেড় হাজার তাহলে কোথা থেকে এলো! সরকারী কোনও সাহায্য টাহায্য এলো না তো? গিন্নিকে ম্যাসেজটা দেখাতেই বলল, ‘আমিই ট্রান্সফার করছি। ওটা তোমার এপ্রিল মাসের স্যালারি। ঘরের কাজকর্ম করার জন্য।’ ‘ভালো কথা কিন্তু মাত্র দেড় হাজার? কাজের বুয়াকে তো তিন হাজার দিতে!’ ’কাজের বুয়াকে তো খাবার দিতে হত না। তোমার দু’বেলার খাবার, চা আর নাস্তার জন্য কেটে নেয়া হয়েছে।’

এই ধরণের ব্যাঙ্গ নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে।

এই লকডাউনকালীন এবং এরপরেও নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারসহ বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। যেমন-

– নারী ও মেয়ে শিশুর সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তাদের সুরক্ষার বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার যৌথভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।

– নারী ও শিশুবান্ধব রিপোটিং ব্যবস্থাপনা আরো জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে ১০৯ এবং ১০৯৮ এর আরো প্রচার বৃদ্ধি করতে হবে এবং এর সেবা আরো দ্রুত করতে হবে; যাতে করে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও মেয়ে শিশু এর সেবা পেতে পারেন।

– স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য মনোসামাজিক পরামর্শ গ্রহণ আরো সহজলভ্য করতে হবে, যাতে করে তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়ে।

– সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টণী আরো শক্তিশালী করতে হবে,
সুবিধাবঞ্চিত নারী ও মেয়েশিশুর পরিবারের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা এবং দৈনন্দিন আয়ের পথ নিশ্চিত করা জরুরি।

– নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি সহিংসতা ও পরিবারের কাজ শুধুমাত্র নারী বা মেয়ে শিশুর কাজ না, পরিবারের সকলের কাজ- এই বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সংগঠন ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচার আরো জোরদার করা জরুরি।

– এই বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ধর্মীয় নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]