আলোর দেখা না পেয়ে অন্ধকারকে বেছে নেয়া
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।। অল্পবয়সি একটি মেয়ের আত্মহত্যা সম্প্রতি আমাদের সবাইকে, স্তম্ভিত করেছে। না এ খবর কোন খবরের কাগজ বা টেলিভিশনে আসেনি। জেনেছি নিজেদের মত করে। কোথাও কেউ আত্মহত্যা করেছে শুনলে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। যদি পরিচিত গন্ডির মধ্যে ঘটে, তাহলে আরও বিমর্ষ হই। জানতে ইচ্ছে করে কোন্ সেই পাওয়া বা না পাওয়া, যার বেদনা বুকে নিয়ে তরুণী বা তরুণরা বাঁচতে চাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়?
বছর দুয়েক আগে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ থেকে জেনেছিলাম, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ জন আত্মহত্যা করে। তার মানে হল, আলোর দেখা না পেয়ে অন্ধকারকে বেছে নেয়ার বৃত্ত ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে বিপজ্জনক হারে বাড়ছে কম বয়সীদের সংখ্যা।
আমরা স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আত্মহত্যা করতে দেখি। শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করে, তা জাতীয়ভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইদানিং পড়ালেখা ও ফলাফল নিয়ে আগের চাইতে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। পড়াশোনা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মা বাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে একটা ছেলে বা মেয়ে যখন ভাবে পড়ালেখা শেষ করে কি করবে, তখন রাজ্যের হতাশা তাকে ডুবিয়ে দিতে থাকে।
আমাদের এই রাজধানীতে যে জীবন যাপন তাকে বলা যায় মহানাগরিক অমানবিকতা। যে তরুণ বা তরুণী নিজের প্রাণটি নিজেই কেড়ে নেওয়ার মতো চরম দুঃসাহসিক কাজটি সমাধা করছে, তাদের কোথায় বেদনা ছিল কেউ জানবে না কখনও।
কেউ যখন আত্মহত্যা করে তখন কী এমন ভাবনা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যে এত বড় সিদ্ধান্ত সে মুহূর্তে নিয়ে ফেলে? ভাবতে গেলে ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যায়। যে পরিবারের সন্তান এভাবে চলে যায় সেই পরিবার বা তার বন্ধুরা কি জানত তার কী এমন হয়েছিল? এই একজন আমাদের মতই স্বাভাবিক ছিল। তারও ভালবাসা ছিল, তিক্ততা ছিল, বই পড়া, টিভি দেখা, ফেসবুকিং করা সবই ছিল। তাহলে হঠাৎ তার মনে এমন কী জেগে উঠল যে নিজেকেই নিজে এই পৃথিবী থেকে, সব প্রিয়জন থেকে সরিয়ে নিল?
আমরা বলছি, তারুণ্য আমাদের সম্পদ। আমরা বলছি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা। সেই তারুণ্য কেন এই পথ বেছে নিচ্ছে তা নিয়ে বড় ভাবনা প্রয়োজন। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মাঝে এই আত্মহত্যা প্রবণতা নিয়ে কোন ভাবনা কোথাও চোখে পড়ছে না। অল্প বয়সীদের আত্মহত্যার প্রবণতার সাথে আছে এখনকার নাগরিক জীবনধারণের সংযোগও। কোথাও কোন আশা নেই, নিশ্চয়তা নেই, সহনশীলতা নেই।
যে আত্মহত্যা করে তার কাছে জীবন তখন অর্থহীন। মৃত্যু তার হাতে তুলে দেয় পালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স। সেই ভাবনা থেকেই এই পার্থিব জীবনকে সে বাতিল করে দেয়।
চরম প্রতিযোগিতার জীবন। কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া। কিন্তু কোথায় যেন এই তারুণ্য খাপ খাওয়াতে পারছে না। পড়ালেখা করে জীবনকে কোন পথে নেবে সেই ভাবনায় অস্থির। প্রায় ৪/৫ লাখ আবেদন পড়ে একেকটা বিসিএস-এ। এই সংখ্যা কোন কোন দেশের পুরো জনসংখ্যার সমান। বোঝা যায়, তারুণ্যের সামনে আর কোন উদ্ভাবনী চয়েস নেই। গায়ে গতরে খাটো, সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ কর, আর সরকারি অফিসার হও। কিন্তু সেটাও সবাই হতে পারবে না। তাহলে গন্তব্য? হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া ছাড়া আর পথ কোথায়?
ব্যাক্তিখাত বিকশিত হতে পারছে না, তাই কাজের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। আত্মকর্মসংস্থানের পথ দুরূহ। পুঁজি নেই, সরকারি প্রণোদনা নেই। কাজ করতে গেলে পদে পদে ঘুষ আর চাঁদা। কোথাও সহযোগিতা নেই। এসব কিছু দেখে আমদের তারুণ্য ভাবছে শুধু পালিয়ে যাওয়ার কথা। এই পালানোই আত্মহত্যা।
রাজনৈতিক উন্মাদনা আছে, ক্রিকেটের উচ্ছ্বাস আছে। কিন্তু জীবন আসলে তদের কাছে খুব বোরিং, বৈচিত্র্যহীন। আমরা চেষ্টা করি এসব কিছুর মাঝেই জীবনকে ভালবাসতে। সবাই পারেনা। প্রেমে ব্যর্থ হলে যেমন কারও কারও কাছে জীবন অর্থহীন লাগে, তেমনি জীবনে অনিশ্চয়তাও তাকে জীবন বাতিলে উদ্ধুদ্ধ করে।
যারা আত্মহত্যা করেছে, তারা চলে গেছে। তাদের অনেক অভিমান ছিল, কেউ দেখেনি, কেউ শোনেনি। দাবির নেশায় আচ্ছন্ন এই সমাজব্যবস্থা নানাভাবে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়। স্বাধীনতা আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবকিছুতে তারুণ্যের অবদান। সেই তারুণ্য আজ কেন উচ্ছলতা থেকে দূরে, জাতীয়ভাবে সেই ভাবনা নেই।
কোন আত্মহত্যার ঘটনা শুনলেই আমরা খুব নিচু স্বরে কথা বলি, ধরে নেই এটি এক নিভৃত কাণ্ড। ধর্মের সাথে সুর মিলিয়ে সমাজ বলে আত্মহত্যা পাপ। কিন্তু কেন মানুষ এ পথে যায় সে কারণ খুঁজে দেখে না, প্রতিকারের প্রচেষ্টা নেয় না। আমরা সবসময় আত্মহত্যাকে অপরাধবোধ আর গ্লানির মোড়কে দেখি, কখনও এর সমাধান হয় না। রাজনীতি ব্যস্ত ক্ষমতার দখল নিয়ে, মানুষের মনের খবর কে রাখে?