September 20, 2024
সাহিত্যফিচার ২বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর ষষ্ঠ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

 

এলেনা অ্যানটিন (Eleanor Antin)

(জন্ম ১৯৩৫)

নিউয়র্কের “হুইটনি অ্যানুয়াল” প্রদর্শনীর জন্য এলেনা অ্যানটিন ১৯৭২ সালে Carving: A Traditional Sculpture নির্মাণ করেছিলেন। অ্যানটিন ঠিক করেছিলেন তিনি একটি অ্যাকাডেমিক ভাস্কর্য বলতে যা বোঝেন সেটাই উপস্থাপন করবেন। আর তাই করার জন্য তিনি খুব কঠোর এক ভোজন ব্যবস্থা বা ডায়েটের ভেতর দিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তাঁর ওজন কমতে থাকলো, এবং জুলাই মাসের ১৫ তারিখ থেকে অগাস্ট মাসের ২১ তারিখ অব্দি, একদিন ছাড়া, প্রতিদিন তিনি নিজের পেছন, সম্মুখ, এবং দুই পাশ থেকে নিজের নগ্ন শরীরের ছবি তুলে গেলেন। এ-কদিনে মোট ৯ পাউন্ড ওজন কমেছিল তাঁর। পুরো কাজটি তৈরি হয়েছিল সব মিলিয়ে ১৪৮টি জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট দিয়ে, এবং সেগুলোকে চারটে ছবির এক একটি স্তম্ভ বা কলামে দেয়াল জুড়ে তারিখ অনুযায়ী সাজানো হয়েছিল।

১৯৭০-এর দশকে নারী শিল্পীরা প্রায়ই তাঁদের (নগ্ন) দেহ নিয়ে শিল্প সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। কারণ তাঁরা তাঁদের দেহকে পুরুষ দর্শকের স্থিরদৃষ্টি থেকে পুনরূদ্ধার ক’রে বা ফিরিয়ে এনে বিষয় বা অবজেক্টকে বিষয়ী বা সাবজেক্ট ক’রে তুলতে চেয়েছেন। অ্যানটিনের কাছে তাঁর দেহই ছিল তাঁর শিল্প, এবং সেই ভোজন ব্যবস্থা বা ডায়েটের ভেতর দিয়ে তিনি যেন ভেতর থেকে তাঁর দেহটিকে “খোদাই” করছিলেন (Carving)। সেই অভিজ্ঞতাটিকে তিনি একজন ক্লাসিকাল বা ধ্রুপদী ভাস্করের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে বা তুলনা ক’রে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, “এই কাজটি গ্রীক ভাস্করদের পদ্ধতিতে করা হয়েছিল, ফিগারটার চারপাশ খোদাই ক’রে; এবং নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার পরেই কেবল সম্পূর্ণ স্তর বেরিয়ে এসেছিল।’’ তিনি মনে করেছিলেন শেষ অব্দি কাজটি যা দাঁড়িয়েছিল সেটাকে সেই রূপটি দিয়েছিল তাঁর নিজের ইচ্ছে বা সংকল্প আর তাঁর ম্যাটেরিয়াল বা উপাদানের সীমা – যে ম্যাটেরিয়াল আর কিছু নয়, তাঁর নিজের শরীর।

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Carving : A Traditional Sculpture (অনুপুঙ্খ বা ডিটেইল)  ১৯৭২

১৪৮টি আলোকচিত্র; জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট এবং টেক্সট

প্রতিটি ১৭.৮ X ১২.৭ সে.মি.

 

মোনা হাতুম (Mona Hatoum)

(জন্ম ১৯৫২)

লেবাননে যখন ১৯৭৫ সালে যুদ্ধ শুরু হলো মোনা হাতুম তখন লন্ডনে। ফিলিস্তিনী মা বাবার সন্তান হাতুম লেবাননে বড় হলেও সেখানে তিনি আর ফিরতে পারলেন না; তখন থেকে লন্ডনেই বাস করছেন তিনি।

তাঁর শিল্পকর্ম Measures of Distance-এ হাতুমের মাকে  আরবী কথা লেখা একটা পর্দার ওপাশে স্নানরত অবস্থায় দেখা যায়। এবং শোনা যেতে থাকে শিল্পী আর তাঁর মা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছেন। বাড়িতে থাকাকালীন সেটা ধারণ করা হয়েছিল। এই আলাপের মাঝে মাঝে শোনা যায় হাতুম বৈরুত থেকে পাঠানো তাঁর মায়ের কিছু চিঠি থেকে পাঠ করছেন।

ভিডিওটি আমাদেরকে নির্বাসন, স্মৃতিকাতরতা, এবং হারানোর একটা গভীর বোধের কথা বলে। হাতুম বলেন, “সেই সঙ্গে, নিষ্ক্রিয় ও যৌনতাবিহীন মায়ের গতানুগতিক সত্তার যে একবারে সুনির্দিষ্ট পরিচয়টি আরব নারী বলতে সাধারণ্যে প্রচলিত, আমি সেটার বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।” যাঁর কন্যাদের সবাই প্রবাসী, হাতুমের মায়ের সেই  চিঠিগুলোতে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চ’লে যাওয়া জীবনের ব্যাপারে তাঁর হতাশার কথা ব্যক্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে তাতে এক কঠোর প্রচ্ছন্ন পুরুষতন্ত্রের ছবিরও দেখা মেলে। তাঁরা যখন দুজনেই নগ্ন হয়ে Measures of Distance-এর দৃশ্য ধারণ করছিলেন তখন হাতুমের বাবা সেটা দেখে ফেলেন । হাতুমের মা লিখেছেন, “সে যখন আমাদেরকে ভর্ৎসনা করছিল তখন আমরা তাকে উপহাস করছিলাম ঠিকই কিন্তু সে আসলেই খুব রেগে গিয়েছিল। এখনো সে ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে খোঁচায়, যেন আমি তোকে এমন কিছু দিয়েছি যেটা কেবল তারই।”

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Measures of Distance ১৯৮৮

ভিডিও প্রজেকশন; কালার এবং  সাউন্ড (মনো)

১৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ড

 

(চলবে)