November 2, 2024
ফিটনেস ও সুস্থতা

নারীর প্রজননস্বাস্থ্য আর আমাদের বাস্তবতা 

লিলিথ অন্তরা।। ছোট বোনকে বইয়ের ‘প্রজনন স্বাস্থ্য’ চ্যাপ্টার বুঝিয়ে দিতে বসলাম। বিজ্ঞান বইয়ে মোটামুটি সবই লেখা আছে, কিন্ত বোনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, স্কুলে এই চ্যাপ্টার ঠিকমত পড়ানো হয়না, পড়ালেও বুঝিয়ে দেয়া হয়না বরং বাসায় পড়ে নিতে উৎসাহিত করা হয়। আপনারা যদি ভেবে থাকেন, কেবল মফস্বল বা গ্রামের স্কুলের চিত্র এটি, তবে ভুল ভাবছেন। খুব নামকরা স্কুলগুলোতেও মোটামুটি একই চিত্র। স্কুলে কেবল নয়, এমনকি পরিবারেও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করা হয়না। বয়ঃসন্ধি সময়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সহজভাবে কিশোর-কিশোরীদের সাথে হাইজিন সম্পর্কিত আলোচনা করার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা কিংবা শ্রেণিকক্ষের পাঠদান খুবই জরুরি।

সাধারণত ১১ থেকে ১৯ বছর বয়স সময়কে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্ট্রেরন হরমোনের কারণে নারীদের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এইসময়ে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয় যা ২৮ দিন অন্তর অন্তর একটা নির্দিষ্ট সাইকেল অনুসারে চলে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার একচতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরী, সংখ্যার হিসেবে তিন কোটি পঞ্চাশ লাখের উপরে। এই বিশাল সংখ্যার অর্ধেক যদি লিঙ্গে নারী হয়, তবে কত শতাংশ কিশোরী মাসিককালীন সচেতনতা সম্পর্কে জ্ঞাত? কতজন পর্যাপ্ত প্যাড ব্যবহার করেন? পরিসংখ্যান বলছে, এর সংখ্যা খুবই কম। কেবল কিশোরী নয় বরং মোটা দাগে বিশাল সংখ্যক নারী মাসিকের সময় প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না। অর্থনৈতিক, সামাজিক, অসচেতনতা ইত্যাদি বিবিধ কারণ রয়েছে এর পেছনে। না, আমি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহিত বা প্যাডের প্রমোশন করছিনা বরং প্রজনন স্বাস্থ্য যে একটি অধিকার এবং নারীর স্বাস্থ্য সমাজে সকল বিকাশের সাথে সম্পর্কিত কেবল তা দেখার চেষ্টা করছি।

নারীর প্রজননস্বাস্থ্য কতোটা উপেক্ষিত তা কিন্তু খুব সহজেই লক্ষ্য করা যায়। প্রতিবছর প্রায় লক্ষাধিক নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, মূত্রনালিতে ইনফেকশানসহ নানা জটিল রোগ। আমার চিকিৎসা বিজ্ঞানের বন্ধুরা এই সম্পর্কে আরো  ভালো ও বিস্তারিত জানবেন। পুরোপুরি না হলেও অনেকক্ষেত্রেই প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বহীনতা এক্ষেত্রে একটি বড় কারণ। আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর পরিবেশও ততোটা অনুকূল নয়, যতটা অনুকূল হলে সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যায়।

ধরুন আপনি জরায়ুমুখ ক্যান্সারের টিকা নিতে যাবেন, আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে আপনি বিবাহিত/অবিবাহিত? অর্থাৎ ভায়া টেস্ট করার প্রয়োজন আছে কি নেই, সেটা জানার জন্য। অথচ এইখানে প্রশ্ন যুক্ত হতে পারত আপনি ইন্টারকোর্সে অভ্যস্ত কিনা? এমনকি প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান সমাজে প্রচলিত- ‘বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে’! এখনো পর্যন্ত বেশিরভাগ নারী বিয়ের পর কনসিভ করতে গিয়ে জানতে পারেন যে তিনি পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম সমস্যায় ভুগছেন।  কিংবা মাসিকের সময় এই করা যাবেনা, ওই ছোঁয়া যাবেনা এসব তো নিত্যদিনের ঘটনা!

স্কুলজীবনে এমন কোন মেয়ে নাই, যে কিনা পিরিয়ড নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়নি। প্রচন্ড পেট ব্যাথা কিংবা অবসাদ নিয়েই প্রতি পদে টিজ আর বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। পিরিয়ড যেন এক ভয়াবহ লজ্জার ব্যাপার এবং একে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রাখতে হবে! এক্ষেত্রে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য তো কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবেই গণ্য হয়না!

আমার নিজেরই খুব বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা ছিল অষ্টম শ্রেণিতে, ঢাকার তথাকথিত এক নামকরা স্কুলে পরা অবস্থায়। আমাদের এক শিক্ষক প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে ঢুকেই এক এক করে পড়া ধরার পাশাপাশি জিজ্ঞাসা করতেন, নামাজ পড়েছি কিনা এবং উত্তর ‘না’ হয়ে থাকলে কুরুচিপূর্ণ হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন ‘কেন’? তো মেয়েরা মাথা নিচু করে থাকত এবং সে মুখ টিপে হাসত। বেশ কয়েকদিন একই জিনিস করার পর একদিন আমরা ক্লাশের ৬০ শিক্ষার্থী একসাথে দাঁড়িয়ে উত্তর দিয়েছিলাম ‘আমাদের সবার পিরিয়ড তাই কেউ নামাজ পড়ি নাই’ এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রিন্সিপালের কাছে লিখিত অভিযোগ করে তার শাস্তি নিশ্চিত করেছিলাম। কিন্তু মফস্বল বা গ্রামের বিদ্যালয়ের অবস্থা তাহলে কী কিংবা কয়টা স্কুলে পিরিয়ডবান্ধব টয়লেট আছে? অথবা সারাদেশের কয়টা শহরে পিরিয়ডবান্ধব টয়লেট রয়েছে? অথচ অনেক নারী মুত্রনালীর ইনফেকশানে ভোগেন এই কারণে।

আইনী দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিভিন্ন আইন যতটা প্রণয়ন করা হয়েছে, সেই আইন বাস্তবায়নেরর পরিকল্পনার পাশাপাশি সঠিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়নি অনেকক্ষেত্রেই। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে সুস্পস্টভাবে বলা আছে, এছাড়া “Adolescent Reproductive Health Strategy Bangladesh 2006” এ প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কিছু কৌশলগ্রহণের রূপরেখা পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবায়নে ধীরগতি কি নারীস্বাস্থ্য বিষয়ে উদাসীনতাকেই প্রশ্ন তুলতে পারেনা? কিংবা প্রতিবার নারীস্বাস্থ্যের জন্য আলাদা করে বাজেটের কতখানি বরাদ্দ রাখা হয়? ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত ট্যাবু, সমন্বয়হীনতা এবং জবাবদিহিতার অভাব সকলক্ষেত্রেই লক্ষ্যনীয়।

মনে রাখা প্রয়োজন নারীস্বাস্থ্য একটি অধিকার এবং তা সরাসরি মানবাধিকারের সাথে জড়িত। তাই সময় এখন নিরাপদ মাসিক নিশ্চিত করা, নারীর স্বাস্থ্য অধিকারকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। স্কুলগুলোতে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সুশিক্ষা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে অভিভাবকদেরকে কাউন্সিলিং এর আওতায় আনা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতে সঠিক জবাবদিহিতায় গড়ে তোলা।

লিলিথ অন্তরা: মানবাধিকারকর্মী