November 24, 2024
সাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর  অষ্টম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

 

জো স্পেন্স (Jo Spence)

(১৯৩৪ – ১৯৯২)

জো স্পেন্স ১৯৬০-এর দশকে নিজস্ব ফটো এজেন্সি স্থাপন করেন। তিনি মূলত কাজ করতেন বিবাহ অনুষ্ঠান আর পারিবারিক প্রতিকৃতি নিয়ে। কিন্তু ’৭০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি প্রামাণ্য আলোকচিত্রের (ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি) ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আলোকচিত্রে নারীকে ছিমছাম, পূর্ব-নির্ধারিত স্টেরিওটাইপ- যেমন, গৃহবধূ, পিনআপ, কনে, ইত্যাদি হিসেবে তুলে ধরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ক’রে তিনি নিজের দেহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন।

তাঁর Remodelling Photo History তিনটি ছবির একটা সিরিয যেখানে নারীর কাছে সমাজের প্রত্যাশাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। ছবি তিনটিতে স্পেন্স ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং সেগুলোকে পুরোপুরি উল্টে দেন। Remodelling Photo History – Colonization-এ তাঁকে দরজার মুখে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। গ্র্যান্ট উড-এর অ্যামেরিকান গথিক  ১৯৩০ নামের বিখ্যাত চিত্রকর্মের পুরুষটি যেভাবে একটি পিচফর্ক ধ‘রে আছেন সেরকম কর্তৃত্বপূর্ণভাবে তিনি এখানে একটি ঝাড়ু ধ’রে রয়েছেন। দুটো দুধের বোতল, বাইরের আলো — ছবিটির এসব গার্হস্থ্য আবহ সত্ত্বেও আমাদের চোখ চ’লে যায় তাঁর শরীরের দিকে। একটা সারং, পুঁতির মালা, ঘড়ি আর রোদচশমা প’রে আছেন তিনি, কিন্তু তাঁর স্তনদুটো উন্মুক্ত, পা নগ্ন। দরজার ধাপটা ঝাড়ু দিয়ে তিনি কর্তব্যপরায়ণ গৃহবধূর ভূমিকাটাকে ‘‘Readers’ Wives’’ নামের পর্নো পত্রিকার যৌন উত্তেজনার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলতে  চান যে নারীকে কোনো ক্যাটাগরির ছাঁদে ফেলা যাবে না।

বিজ্ঞাপনগুলো যেভাবে স্টেরিওটাইপগুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরে, এবং সত্য হিসেবে যেসব মিথ্যেকে প্রচার করে তা নিয়ে জো স্পেন্স প্রশ্ন তুলেছেন। যেন সত্য নয়, বানানো কাহিনীর খেলা চলছে, এবং প্রায়ই অকপট রসবোধ আর সাহসিকতার সঙ্গে স্পেন্স সে খেলার স্বরূপ উন্মোচন ক’রে মজা পাচ্ছেন।

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Remodelling Photo History: Colonization ১৯৮১-৮২

আলোকচিত্র; কাগজের ওপর টিনটেড জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট; টেরি ডেনেট-এর সঙ্গে যৌথভাবে

৭০ X ৫০ সে.মি.

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

গ্র্যান্ট উড-এর ‘American Gothic’, ১৯৩০

 

বারবারা ক্রুগার (Barbara Kruger)

(জন্ম ১৯৪৫)

১৯৭০-এর দশকের বহু নারীবাদী শিল্পীর মতো বারবারা ক্রুগার-ও আলোকচিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কারণ তা বড় মাপের পেইন্টিং ও ভাস্কর্য তথা পুরুষ সৃজনশীলতার ঠিক বিপরীত বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। শিল্পকলায় ‘Found photography’ বা ‘প’ড়ে পাওয়া আলোকচিত্র চর্চা’  ব’লে একটা কথা আছে, আর সেটা হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া, দাবীবিহীন, বা ফেলে দেওয়া আলোকচিত্রের পুনরুদ্ধার এবং সম্ভাব্য প্রদর্শনী-নির্ভর আলোকচিত্র চর্চা বা ভিজ্যুয়াল আর্টের একটি ঘরানা। বারবারা ক্রুগার এইসব প’ড়ে পাওয়া সাদা-কালো প্রতিচ্ছবির ওপর সারগর্ভ, সাহসী বক্তব্য ‘সানস-সেরিফ’ বা ‘অক্ষরের শেষে বাড়তি আঁচড়বিহীন’ ফন্টে প্রিন্ট ক’রে লাল এনামেল ফ্রেমে প্রদর্শন করতেন।

Untitled (Your gaze hits the side of my face)-এ আমরা পাশ থেকে এক নারীর মাথা দেখতে পাই। তাঁর পক্ষে আমাদের স্থিরদৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়; “সহ্য ক’রে নেয়া” বা “গ্রহণ ক’রে নেয়া” ছাড়া সেটির উপায় নেই। সেটা একটি বিষয় বা বস্তু, যার দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি। আর সেটা আরো উচ্চকিত হয়েছে এই কারণে যে  ক্রুগার এমন একটি ভাস্কর্যের মাথা ব্যবহার করেছেন যেটার প্লিন্থ বেশ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান (প্লিন্থ হচ্ছে যে চৌকো বেদীর ওপর কোনো মূর্তি বা স্তম্ভ, ইত্যাদি দাঁড়িয়ে থাকে সেটি, এককথায় স্তম্ভ বা মূর্তিপাদপীঠ- অনুবাদক)।

ক্রুগার যে এভাবে কথা এবং ছবি পাশাপাশি বসান, তা কখনো কখনো প্রতিচ্ছবিটির প্রকৃত অর্থের বিরুদ্ধভাব প্রকাশ করে, বা সেটাকে জটিল ক’রে তোলে। গোড়াতে ক্রুগার একজন গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। চিহ্নের শক্তি যে সমাজের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেকথা তিনি তখনই উপলব্ধি করেছিলেন। যেসব সনাতনী, গতানুগতিক প্রতিচ্ছবি আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় — বালিকারা খেলছে, সমাজে পুরুষের অভিষেক ঘটছে- এসব বিষয় নানান টেক্সট এমন একটা সমস্যা হিসেবে তুলে ধরে যে সমস্যার সমাধান বেশ জরুরি: “You make history when you do business”; “We no longer be seen not heard”। ক্রুগারের নিজের ভাষায় তিনি “পুরুষ অডিয়েন্সের মাঝে নারী দর্শককে স্বাগত জানাতে চান,” এবং  “বিশেষ কিছু রেপ্রিজেন্টেশন বা প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থাপনকে ধসিয়ে দিতে চান।” জেন্ডার জন্ম নেয় না, সেটাকে নির্মাণ করা হয়, উৎপাদন করা হয়, এবং কোনো প্রতিচ্ছবি-ই নিরপেক্ষ নয়। তিনি প্রবল প্রত্যয়ের সঙ্গে একথা ঘোষণা করেন যে, “আমাদের শরীর একটি যুদ্ধক্ষেত্র।”

 

শিল্পকর্ম পরিচিতি:

Untitled (Your gaze hits the side of my face) ১৯৮৩

ফটোস্ট্যাট, লাল রঙ করা কাঠের ফ্রেম

১৪০ X ১০৪ সে.মি.

 

(চলবে)

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল

পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ

পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র

পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন