November 2, 2024
ফিচার ১সাহিত্যগল্প

একজন দেমাগী মেয়ের গল্প

সিদ্রাত মুনতাহা।।

এই ক্রিমটা মাখিস, তোর খালা বিদেশ থিকা নিয়া আইছে

ক্যান মাখব মা? এই ক্রীম দিলে কী হবে?

আরে একটু ফর্সা হবি

আমি কি ফর্সা হইতে চাইসি মা?

আরে, বুড়ি ধামড়ি মেয়ে, বিয়ে হচ্ছেনা তোর গায়ের রং এর জন্য, এইরকম বাজে জেদ করলে জীবনেও বিয়ে হইবে না

না হইল মা, বিয়ে করার জন্য আমার বয়েই গেছে

বেয়াদব মেয়ে একটা, শুধু মুখে মুখে তক্কো…

টানা ১০ বছর ধরে একই কথা শুনে আসছে রুপা। ১০ বছর আগে যখন সে ইন্টারমিডিয়েট পড়ত, তখন থেকেই চেষ্টা তদবীর ছিল তাকে বিয়ে দেওয়ার, কারণ তার গায়ের রং এমনিতেই ময়লা, বেশি বয়স হলে বিয়ে হবে না। কিন্তু রুপাও কম যায়না, জেদ ধরে বসছিল বিয়ে করবে না, সে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেই, গায়ের রং ময়লা বলে যাকে তাকে বিয়ে করে বসবে নাকি, ইহহহ শখ কত! গায়ের রং ময়লা তো কী হইসে, রুপা নিজের চোখে বরাবরই বড় সুন্দরী।

আজ ১০ বছর পর গ্রাজুয়েশন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছে রুপা, এখনো অবিবাহিত এবং সিংগেল, এবং তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। থাকবেই বা কেন? সে সুশিক্ষিত, স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ব্লগার, ভালো স্যালারি, সুন্দর বাসা, কী নেই তার? কেন সে দুঃখ পাবে? গায়ের রংটা সাদা নয় বলে?

মোটেই না। রুপা ভীষণ সুখী তার জীবন নিয়ে।

তার মা প্রায়শই বলে

বিয়ে ছাড়া একটা মেয়ের জীবন অসম্পূর্ণ, মেয়েমানুষের চলতে ফিরতে একটা পুরুষ লাগেই,

রুপার ভীষণ বোগাস লাগে এসব কথাবার্তা ,তার তো লাগে না কোনকিছু অসম্পূর্ণ, কী হইসে যে তার জীবনে পুরুষ  মানুষ নাই! সে তাতে কোন অসুবিধা দেখেনা, হাসিখুশি বিন্দাস আছে। অবশ্য সম্প্রতি সে তার এক কলিগের প্রেমে পড়েছে। পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার নিয়ে সবসময় এতটাই ব্যস্ত থেকেছে যে কখনো সময় পায়নি এসব নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার,তার বান্ধবীদের দেখত চুটিয়ে প্রেম করছে। রুপার মনে হয়নি তার জীবনে এই বস্তু খুব প্রয়োজন, তাছাড়াও একটা নির্দিষ্ট সময় পর সে যখন বুঝতে পারলো যেসব পুরুষ তার কাছে আসতে চেয়েছে তারা শুধুমাত্র শরীরের টানে আসতে চায়, তখন থেকে সে প্রেম নামক জিনিসটাকে লাইফের অপ্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবেই গন্য করেছে। প্রেম না করলে তার জীবন বৃথা হয়ে যাবেনা। বন্ধুমহলে সবাই যখন ক্ষেপিয়েছে,”কি রে একটা প্রেম করতে পারলিনা?”

সবসময় কড়াভাবে সরাসরি জবাব দিয়েছে,”মনে হয়না আমার প্রেমের পেছনে নষ্ট করার মতন সময় আছে”।

ইদানিং মা অতিরিক্ত চাপাচাপি করছে বিয়ে নিয়ে, ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকর।

রুপা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেনি যে সে জীবনে বিয়েই করবেনা।

রুপার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সে বিয়ে করার জন্য ঘষেমেজে ধলা হতে পারবেনা। ইশ শখ কত! সে কি কোন পণ্য নাকি যে পালিশ করে সবার সামনে উপস্থিত করতে হবে! রুপা ভাবে সে এত সস্তা হয়ে যায়নি যে যাকে তাকে বিয়ে করে বসবে।

রুপার আত্মীয়স্বজনরা বরাবরই বলে মেয়ের এত দেমাগ ক্যান? রাজপুত্তুর চায়! নিজে মনে হয় রাজকুমারী! কালী পেত্নী!

রুপা মুখে মুখে জবাব দেয়, হ্যাঁ আমি তো রাজকুমারীই। আর কালী পেত্নী আমি না,কালী পেত্নী তোমাদের মনে।

রুপার এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য কম কথা শুনতে হয়নি রুপাকে, রুপা সেগুলার থোরাই কেয়ার করে।

আজকাল তার যে কলিগকে বেশ ভালো লাগছে, রুপা ভাবল, তাকে জানিয়ে দেবে ভালো লাগার কথা। রুপার একমাত্র ভালো বন্ধু  রুমা।দেশের বাইরে থাকে, বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক আগে, লন্ডনে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রেম হয়ে গেছে একজনের সাথে আর সেখানেই বিয়েসাদী করে সেটেলড। রুমা হচ্ছে রুপার একমাত্র বন্ধু যে সারাজীবন সব ব্যাপারে রুপাকে সাপোর্ট করে গেছে, যে রুপার গায়ের রং নিয়ে কখনো বাজে কথা বলেনি, রুমা এমন একজন যাকে যে কোন কিছু বলা যায়।

রুমা শোন আমি ভাবছি প্রফেসর সাহেবকে প্রপোজ করে ফেলব

কি বলিস তুই ক্যান প্রপোজ করবি?এটা কি ঠিক হবে? মেয়েরা কখনো আগে প্রপোজ করেনা, এতে সম্মান কমে যায়

একটা শিক্ষিত মেয়ে এসব কি ছাইপাঁশ বলিস তুই রুমা? প্রপোজ করলে কেন সম্মান কমবে? আমি তো তাকে ভালো লাগার কথা জানাবো, ভালো লাগার কথা জানালে মানুষের সম্মান কমে?

যাহ বাবা তোকে নিয়ে আর পারব না, যা খুশি কর গিয়ে…

সেইদিন রুপা অফিসে গেল লাল শাড়ি পরে। সবাই বলে লাল রং নাকি তার জন্য না, রুপাকে নাকি লালে পেত্নী লাগবে। রুপা কি এসবের ধার ধারে! রুপার তো মনে হচ্ছে তাকে দেখতে বেশ রুপসীই লাগছে। অফিসে ঢুকতেই বুঝলো ইকবাল তার দিকে হা করে চেয়ে আছে । রুপার একটু লজ্জা করতে লাগল, আজ সে প্রথমবারের মত কাউকে প্রপোজ করবে!

অফিস শেষে দুজন একসাথে রেস্টুরেন্টে খেয়ে টিএসসির উদ্দেশ্য রওনা হল। রুপার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এটা, ঠিক করেছে তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গাতেই মানুষটাকে ভালোবাসার কথা বলবে।

হাকিম চত্বরে এসে বসল ওরা দুজন।

ইকবাল বলল, ‘‘রুপা আপনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে’’

রুপা মৃদু হাসল। কেন জানি আজ তার লজ্জা করছে, সারাজীবন নির্লজ্জ বেহায়া উপাধি শুনে আসা মেয়েটা আজ কেন জানি লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে, এমন হচ্ছে কেন সে নিজেও বুঝতে পারছেনা।

তবে সংকোচে কেটে গেল কিছু পরেই। রুপা বলে ফেলল, ‘‘আমি আপনাকে ভালোবাসি”।

ইকবাল কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

সত্যি বলছেন?

দেখুন প্রেম করা বা প্রেম নিবেদন করার বয়স ফুরিয়েছি বহু আগেই, এত বছর পর এই বয়সে এসে এ কথা বলছি নিশ্চয়ই মিছেমিছি বলছিনা!

আমার পরম সৌভাগ্য যে আমায় ভালোবাসেন। আমি আপনাকে বহুবার বলতে চেয়েছি, সাহস হয়নি, ভেবেছি কি না কি ভেবে বসেন বা যদি রেগে যান! আমি তো আপনাকে ভয় পাই! হাহাহা।

রুপা হেসে দিল।

চলুন, বিয়ে করে ফেলি, ইকবাল বলে।

এখন?

অবশ্যই এখন, বয়স তো কম হল না, তাছাড়া আমার সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে। তার আগেই বিয়েটা করে ফেলি, যেন স্বপ্ন ভাঙ্গলেও আফসোস না থাকে। বিয়ে তো করতে পেরেছি আপনাকে!

ঠাট্টা করছেন আপনি?

উহু, মোটেই না। তাছাড়া লাল শাড়িতে আপনাকে এমনিতে বউ বউ লাগছে, একদম পারফেক্ট বউ লুক, দেরি করে লাভ নেই। এই তো সামনেই কাজী অফিস, চলুন।

অতঃপর

প্রথমবারের মত জীবনের কোন সিদ্ধান্ত রুপা এত জলদি নিয়ে ফেলল।

রাত ৯ টায় নবদম্পতি ইকবাল আর রুপা হাজির হলো রুপাদের বাসায়।

রুপার চাচা, চাচী, খালা, মা, বাবা, ছোটভাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে ওদের দুজনকে।

সারাজীবন রুপার কোনদিন বিয়ে হবেনা, এমন দেমাগী মেয়েদের বিয়ে হয়না, ভালো বর পাবে না,কপালে খারাবি আছে বলা মানুষগুলো রুপার দিকে তাকিয়ে আছে।

হ্যাঁ, রুপা সত্যিই সত্যিই তার রাজপুত্র খুঁজে নিয়েছে। ফুটফুটে বরের পাশে আজ প্রথমবারের মত রুপার গায়ের রংয়ের জন্য গালমন্দ করা মানুষগুলোরও বোধ হল রুপা তো সত্যিই মহাসুন্দরী! কি দারুন মানিয়েছে ওদের দু’জনকে!