যে পথ কোথাও যায় না
আবু তালহা।। সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। এক কালে বর্ণ চেনার আগেই দাদি-নানির মুখে এসব নীতি কথা শিশুদের শেখা হয়ে যেত। মামা-কাকা চঞ্চল শিশুদের উদ্দেশে বলতেন— লাফালাফি দেখলে ডারউইনের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। প্রতিবেশীরাও পিছিয়ে থাকতেন না! কিশোরদের জন্য বরাদ্দ ছিল দণ্ডবিধির ধারা— এখনই যা লক্ষণ, বড় হলে ‘ফোর টোয়েন্টি’ হবে।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালেই সোশ্যাল স্ট্যাটিফিকেশন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যেত। কারণ তখনই ‘ভুল’ করার উপযুক্ত সময়। সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার সময়। গড়ে ভেঙে ফেলার সময়।
হঠাৎ করে আমাদের দেশে বিদ্যার এমন বিপ্লব ঘটে গেল, আজকাল লোকের কথায় বিদ্যার যোগ ধরতে পারাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশ্য এতো কিছু না জানলেও বিশেষ অসুবিধা হয় না। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হয়েছে, এ প্লাস বি হোল স্কয়ার ইকোয়ালটু এ স্কয়ার প্লাস টু এ বি প্লাস বি স্কয়ার। বাস্তব জীবনে এটা কোথায় প্রয়োগ করা যায়, সেটা জানার সৌভাগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার আগে খুব কম জনেরই হয়েছে। এটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।
মোটা দাগে সে কাল-এ কালের শিক্ষাজীবন পর্ব দেখা গেল। না তলিয়ে আরেকটু ভেবে দেখা যাক। পরের পর্বের দিকে তাকালে প্রথমেই যে শব্দটা মনে পড়ে তা হলো রিকনসাইল।
এই শব্দটার সুনির্দিষ্ট নজির বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত মানসিকতায় যেভাবে দেখা যায়, তাকে অতুলনীয় বলা হলে কেউ আপত্তি তুলবেন না সেই আস্থা রাখা যেতে পারে। ‘টাকাই কি সব’ এবং ‘টাকাই সব না’ এই দুটি বাক্যের সুবিধাজনক ব্যবহার যদি কখনো কমে যায়, তাহলে রিকনসাইল শব্দটা অভিধানে আর না রাখলেও চলবে।
‘বিত্ত’ শব্দটা যখন আছে, তখন টাকা যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলে না দিলেও চলে। সমাজের শ্রেণি বিভাজন বিত্তের ভিত্তিতে হলেও কেবল ‘মধ্যবিত্ত মানসিকতার’ জিকির শোনা যায়। চিন্তা ও আচরণকে বিত্ত কীভাবে প্রভাবিত করে সে আলাপ এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী তা এখনো বিস্ময়সূচক প্রশ্ন হয়ে আছে।
বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সেই নিয়ম মেনে একটা সময় পর্যন্ত সোশ্যাল স্ট্যাটিফিকেশন সহজ জীবনে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। এর পরে অবশ্য পেন্ডুলামের মতো সুবিধাজনক দিকে দুলতে থাকে।
তেমন একটি গল্প শোনাতে চাই। কাইয়ুম সাহেব সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। অবসর নেওয়ার আগে বড় বড় শহরে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি আবাসন প্রকল্পে থেকেছেন। রেশন পেয়েছেন। যে কারণে প্রত্যাশা কিংবা চাহিদার তুলনায় বেতন কম হলেও বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয়নি।
সে সময় সরকারি বিদ্যালয়, সরকারি মহাবিদ্যালয়ে সরকারি বড় কর্মকর্তাদের সন্তানরা বিশেষ স্নেহ পেত। কাইয়ুম সাহেব অবসর নেওয়ার পরে সমস্ত টাকা দিয়ে নিজের ঠিকানা গড়ে তোলেন। এখন মাসে মাসে অবসর ভাতা পান।
তবে তার একমাত্র ছেলে সুজয় সরকারি কর্মকর্তা হতে পারেনি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনের চাকুরে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত হলেও মানসিক স্তর তাকে ছেড়ে বহু দূরে চলে গেছে অনেক আগে। সুজয় রবীন্দ্র সঙ্গীত ভালোবাসে। ছুটির দিনে আকাশে মেঘ দেখলে জীবনানন্দ মেলে বসে। কখনো কখনো বাড়ির ছাদে প্রিসলির গান গুনগুন করে। পুরো মাস হলিউড জ্বালালেও বেতন পেয়ে প্রথমেই এক প্যাকেট ডানহিল কেনে।
সুজয় যখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, তখন মনিকার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যায়। কথা শুরু হয়েছিল ফার্স্ট ইয়ারে। পরে আর সামনাসামনি হওয়ার সাহস সুজয়ের হয়নি। মনিকা এখন লন্ডনে থাকে। রাজপুত্রের মতো দেখতে দুই ছেলে তার। সুজয়কে মনিকার বাবা চিনতেন, তাই মেয়ের কল্যাণ কামনায় বিলেতে স্থায়ী পাত্রে কন্যা সম্প্রদান করেন। এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি।
কাইয়ুম সাহেবের স্ত্রী জ্যোৎস্নাও মনিকার সম্পর্কে জানতেন। সমস্ত দিক বিবেচনা করে তাই সিদ্ধান্ত নেন, ছেলের বউ তিনি নিজেই খুঁজে বের করবেন। অত শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই; গ্রামের মেয়ে; সহজ-সরল; দেখতে মোটামুটি; ঘরের কাজ জানবে; স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করবে, আর কী চাই! সে অনুযায়ী হলো। কাছের স্বজনের উপস্থিতিতে সুজয়-আকলিমার বিয়ে হলো।
এই বিয়েতে সন্তুষ্ট ছিলেন কাইয়ুম সাহেব ও জ্যোৎস্না বেগম। সন্তুষ্টির দুটি বড় কারণ ছিল। চাহিদা অনুযায়ী ছেলের বউ ঘরে আনা গেছে এবং বিয়ের আয়োজনের খরচটা সাধ্যের বেশি বাইরে যায়নি। আকলিমার বাবা-মা মনসুর আলী ও সালমা আক্তারের সন্তুষ্টি তার চেয়ে কিছু কম ছিল না! মেয়ে জামাইয়ের কোনো চাহিদা নেই, শুধু মেয়ে চায়। বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে হয়েছে— মেয়ে সুখী হবেই! বড় দায়িত্ব পালন শেষ হলো।
প্রথম রাতেই সুজয় জেনে যায়, আকলিমা কোনোদিন জীবনানন্দ পড়েনি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা যা করেছে, তা পরীক্ষা পাসের জন্য। রবীন্দ্রনাথের গান তাকে টানে না। পথের ধকলে ক্লান্ত আকলিমা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। সুজয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি বাক্য, ‘নেচার নেভার ডিড বিট্রে দ্য হার্ট দ্যাট লাভড হার’।
পরের দিন সবার আগে ঘুম ভেঙে যায় আকলিমার। ‘বাবার বাড়ি’ থেকে বেরিয়ে সামান্য হাঁটলেই পুরো আকাশটা একবারে দেখা যেত। বিয়ের পরে প্রথম সে জানালা দিয়ে আকাশ দেখলো। এক খণ্ড আকাশ, চৌকোণা। যে আকাশে পাখি দেখা যায় না। যে আকাশে পাখি ওড়ে না। মেঘ ভেসে ভেসে কোথায় যায়, জানা যায় না।
কাইয়ুম সাহেবের পরিবারের গল্প নার্সারিতে সারি সারি বনসাইয়ের মতো পুরনো হতে থাকবে। আকারে ছোট হলেও নতুন পাতা গজাবে, ডাল বের হবে। সে গাছের তুলনায় প্রকাণ্ড মানব নতুন ডাল ভেঙে দেবে, ধাতব তারে শেকড় বেঁধে দেবে। দিনে দিনে নার্সারিতে বাড়বে গাছের সংখ্যা। বৃক্ষমেলার বড় বড় আয়োজন হবে। ঘরে ঘরে সাজবে বনসাই। যে গাছে কখনো ফল ধরে না, ফুল ফোটে না।