November 22, 2024
কলাম

সিঙ্গেল ফাদার নমস্য! সিঙ্গেল মাদার ভবিতব্য!

শাশ্বতী বিপ্লব।।  সংসারে বাবা চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। বাবা হলেন বাড়ির কর্তা। বাবাকে দেখেই পরিবারের ছোট্ট ছেলেটি ক্রমশ কর্তা হয়ে উঠতে শেখে। শেখে, তাকেও একদিন আয় করতে হবে। মাচোম্যান হতে হবে। তারপর নিজেরও সংসার হবে একদিন, বউ আনবে ঘরে, তারও ছেলেপুলে হবে। সেই সংসারে সেও কর্তা হবে। বাবার মতো।

বাবাকে দেখে শেখে ছোট্ট মেয়েটাও। কর্তৃত্ব মেনে নিতে শেখে, অধঃস্তনতা শেখে। শেখে পরিবারের কর্তার যত্নআত্তির নিয়ম কানুন। কর্মজীবী মা ঘরে থাকলে, সেও কর্মজীবী হওয়ার একটা স্বপ্ন দেখে হয়তো, তবুও সংসারের কর্তা হওয়াটা ঠিক শেখা হয় না। বরং শেখে, একদিন সেও অন্যের সংসারে যাবে। সেখানেও একজন কর্তা থাকবে, বাবার মতো। সেটা সে আয় করলেও বা না করলেও। কোথাও যদি এর কোন ব্যতিক্রম থাকে, সেটা অতি নগন্যই।

বাবা সন্তানের আইনগত অভিভাবক। স্কুলে, পাসপোর্টে, ব্যাংকে, জমিজমার দলিলে, সব জায়গায়। মা হলেন নিছক কাস্টোডিয়ান। কোন কারণে বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে গেলে আদালত একটা বয়স পর্যন্ত মার কাছে সন্তানকে থাকতে দেবে। পেলেপুষে বড় করে দেয়ার জন্য। কিন্তু অভিভাবকত্ব দেবে না। আইনে নাই কিনা।

এই যে সংসারের কর্তা বাবা, সন্তানের লিগ্যাল অভিভাবক বাবা, সেই বাবাকে কোন কারণে একা সন্তানের দায়িত্ব নিতে হলে কেন যেন সব জট পাকিয়ে যায়। সন্তানের দায়িত্ব একা নিতে নিজেও কেমন যেন ভরসা পায় না, আবার সমাজও তাকে একা নিতে দিতে চায় না। বিশ্বসংসারে সিঙ্গেল মাদার বা একা মা ভুড়ি ভুড়ি থাকলেও, সিঙ্গেল ফাদার বা একা বাবা হাতে গুনে ফেলা যাবে। আমাদের সমাজে বিধবা বা ডিভোর্সি মায়ের একা থাকাটা ভবিতব্যের মতো হলেও, বিপত্নীক বা ডিভোর্সি বাবার একা থাকাটা মোটেও কাম্য নয়।

কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে বা বউ মরে গেলে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই উঠে পড়ে বউ খুঁজতে লেগে যায়। সবার একটাই চিন্তা, একা কী করে থাকবে লোকটা? বিয়ে তো দিতেই হবে। হোক সে ঘাটের মরা কিংবা মাঝবয়সী বা তরুণ যুবক। যুক্তি হিসাবে একে একে যুক্ত হয়, লোকটার ছেলেপুলে কে পালবে? লোকটা খাবে কী? লোকটার যত্নআত্তি, সেবা কে করবে? (লোকটার শারীরিক চাহিদা কে মেটাবে? – এই কথাটা মুখ ফুটে না বললেও, সবারই মনেই থাকে কথাটা।) লোকটার বয়স যদি খুব বেশি হয়, তাতেও কুছ পরোয়া নেহি। গ্রাম থেকে গরীব কোন আত্মীয় বা অনাত্মীয়কে এনে বিয়ে দিয়ে দাও । পুরুষমানুষ একা থাকতে পারে নাকি?

এর ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া হয় নারীর ক্ষেত্রে। কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে বা স্বামী মরে গেলে, আত্মীয় অনাত্মীয়, বন্ধু বান্ধব সবাই আশা করে, বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবনটা সে একা কাটিয়ে দেবে। হোক সে একদম তরুণী কিংবা বয়স্ক। একা একা সব কর। আর শারীরিক চাহিদা? সেটা আবার কী জিনিস? এমনিতে, একলা পেলে কাছের লোকজনও সুযোগ নিতে ছাড়বে না। কিন্তু বিয়ে? ছিঃ ছিঃ।

এসবের ভিড়ে যেসব বাবারা একা সন্তান পালনের সিদ্ধান্ত নেন, বিয়ে না করে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেন জীবন, তারা নমস্য এই সংসারে। বাহাবা পাওয়ার যোগ্য। তারা মানুষরূপী অবতার। এর বিপরীতে, সিঙ্গেল মায়ের কপালে এইসব বাহাবা কদাপি জোটে। সিঙ্গেল বাবার সন্তানেরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়লে বা বখে গেলে বরাবর সহানুভূতি পান। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেন নাই, এটাই তো বিশাল ত্যাগ! সহানুভূতি মায়েদেরও জোটে কখনো সখনো, তবে যথেষ্ট দোষারোপ করার পর।

একা সন্তান পালন কঠিন। সেটা যেমন বাবার জন্য, তেমন মায়ের জন্যও। তারপরও এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, সংসার একদিকে শুধু বাবাকে সন্তানের আইনী অধিকার দিয়ে, তাকে সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিতে মুখিয়ে থাকে। আর অন্যদিকে মাকে নিছক কাস্টোডিয়ান বানিয়ে রেখে সকল দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। আবার বিয়ে না করলেও, সিঙ্গেল বাবার মেয়েবন্ধু থাকা স্বাভাবিক।  সিঙ্গেল মায়ের ছেলেবন্ধু থাকাটা দুশ্চরিত্রের লক্ষ্মণ।

একা বাবা কিংবা মা, দুজনই সমান নমস্য বা সমান সহমর্মিতা পাওয়ার যোগ্য। তবে দুজনের কাউকেই ‘টেইকেন ফর গ্র্যান্টেড’ ধরে নেয়াটা অপরাধ। আবার দোকা হওয়ার সুযোগ বা গ্রহণযোগ্যতাও দুজনের জন্যই সমান থাকা উচিত। যেকোন একটাকে আলাদা করে মহিমান্বিত করার কিংবা চাপিয়ে দেয়ার কিংবা দোষারোপ করার প্রবণতা ক্ষতিকর এবং বৈষম্যমূলক। আজকাল এসব চাপিয়ে দেয়া নিয়ম ভাঙ্গতে পারছে অনেকেই, সেটাই যা একটু আশার কথা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]