‘পুরুষালী’ নই, মশকরা, কটুক্তি, ব্যুলিয়িং- সব ঘটেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
রাহাত হোসেন অনিক।। গোটা বিশ্ব এখন রেসিজম, নেপোটিজম বা অন্যান্য বৈষম্য নিয়ে কথা বলছে। আমার ধারণা এই ধরণের বৈষম্য (নেপোটিজম, সেক্সিজম, কালারিজম, ক্লাসিজম, বডি শেইমিং ইত্যাদি) এর হাতেখড়ি হয় আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই। আমি আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা দ্বারা এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারি।
স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সবখানেই আমি বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই তথাকথিত পুরুষালী নই, বরং অন্যদের মতে নারীসুলভ বা মেয়েলী ধরনের। এই নিয়ে তখন থেকে এখন পর্যন্ত কটুক্তির শিকার হয়েছি এবং অদূর ভবিষ্যতেও হব ভেবে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি।
ভয়ে এবং বিভিন্ন ঘটনার কারণে আমি ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতাম না এবং মেয়েদের সাথেই খেলাধুলা, আড্ডা ইত্যাদি দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম।
স্কুলে যখন টিফিন পিরিয়ডে ডেস্কের সামনে মেয়েরা গানের কলি খেলত এবং ছেলেরা মাঠে ক্রিকেট খেলত, তখন আমি মেয়েদের সাথে গানের কলি খেলাটাই পছন্দ করতাম।
এতে অন্যান্য ছেলেরা মাইজ্ঞা, হিজড়া, হাফ লেডিস, আর আমার সামনের দুটো দাঁত তুলনামূলক ভাবে বড় বিধায় দাঁতাল ইত্যাদি বলত। স্কুলে থাকাকালীন আমি কখনো টকজাতীর কোন ফল বা আচার কিনে খেতে পারিনি তাদের ভয়ে। শিক্ষকদের কাছে বিচার দিয়েও ওদের চুপ করাতে পারিনি, বরং অনেক শিক্ষক এটাও বলেছে যে ‘‘মেয়েদের সাথে কেন মিশো, মেয়ে হবা?’’
যারা ব্যুলি করত, তাদের অধিকাংশই উক্ত শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ত বলে তাদের সাত খুন মাফ হইত। আমি কখনোই এই ব্যাপারে কোন শিক্ষক বা শিক্ষিকার কাছে থেকে কোনরকমের সাহায্য পাইনি, বরং তখন শিক্ষকদের নিজস্ব ব্যাচে না পড়ার অপরাধে অংকে বা বিভিন্ন বিষয়ে কম নাম্বার পেয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি।
আমার শত চাওয়াতেও কখনো স্কাউট, রেড ক্রিসেন্টে নেওয়া হত না। আমি হেলেদুলে হাঁটতাম, হাত নেড়ে কথা বলতাম (যেটা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক ছিল) বিধায়।
একবার স্কুল থেকে জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত কোন এক অনুষ্ঠানে প্রায় ১১শ বা ১৫শ শিক্ষার্থীর (যাদের মধ্যে কমপক্ষে ৮শ জন ছেলে) মধ্য থেকে ৭০ জন মেয়ে এবং আমি একমাত্র ছেলে ছিলাম যে কিনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং স্কুলের মান রেখেছিলাম। অথচ অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আমাকে বাহবা দেওয়ার সাথে অনেকের কাছে থেকে এটাও শুনতে হয়েছিল যে, ‘‘ওরে কেউ ছেলে হিসেবে মানে?’’
তখনও আমার কোনো সহপাঠী বা কোন শিক্ষক ও শিক্ষিকা প্রতিবাদ করেননি আমার হয়ে।
কলেজে এক বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষিকা বা শিক্ষার্থীদের অন্য বিভাগের সাথে প্রতিযোগিতা লেগে থাকত। ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারগুলো আমি পছন্দ করতাম না। সবার সাথেই সু-সম্পর্ক বজায় রাখতাম; এতে ‘সর্বহাটের কাঁঠালি কলা’ বা ‘দো’আঁচলা’ জাতীয় ট্যাগও পেয়েছি।
আমি সবসময় আমার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, তোঁতলানো স্বভাব নিয়ে কথা শুনেছি তাদের কাছে থেকে; এই নিয়ে এখনও আমি হীনমন্যতায় ভুগি এবং কথা বলা বা কোনো প্রেজেন্টেশন দিতে গেলে বারবার ভাবি যে আমাকে কেমন দেখাবে!
ভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের অফিসে যখনই কোন কাজে গিয়েছি আমার ভিন্নধর্মী পোশাক-আশাকের জন্য বা আমার ভিন্ন ধরনের ছবি তোলা এবং সোশ্যাল সাইটে পোস্ট করা নিয়ে মশকরা বা টিপ্পনীও শুনেছি।
এই সব প্রত্যেকটা কথা সত্য এবং আমি এর প্রমাণ দিতে পারবো।
এটাতো শুধু আমার সাথে ঘটা কিছু ব্যাপার।
এছাড়াও লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন শিক্ষকেরা তাদের শিক্ষার্থীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘ওই কালো মেয়ে বা ছেলেটা, মোটা মেয়ে বা ছেলেটা, রোগা মেয়ে বা ছেলেটা’ ইত্যাদি ব্যবহার করছেন।
এছাড়াও ছেলে এবং মেয়েদের ভিন্ন রঙের ইউনিফর্ম, তৃণমূল পর্যায়ে ভিন্ন পাঠ্যবই, চোখে আঙুল দিয়ে শেখানো ছেলে আর মেয়ে আলাদা- এসব তো আছেই। এমন কি সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের যে যৌনশিক্ষা অধ্যায়টা আছে সেটাও এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং মেয়েদের জন্য গার্হস্থ্য অর্থনীতি আর ছেলেদের জন্য কৃষিশিক্ষা এইভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, জাতিগড়ার কারখানা বা যেখানে জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি হওয়ার কথা সেখান থেকে এমন অভিজ্ঞতা লাভ করলে স্বাভাবিকভাবে পরবর্তীতে ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রভাব থাকবেই। আমি নিজেও এর বাইরে ছিলাম না, আমি নিজেও কোন না কোন সময় এই ধরনের বৈষম্য চর্চা করেছি কারণ আমার শিক্ষাব্যবস্থা আমাকে এগুলোই শিখিয়েছে। এইসব ব্যাপার যে সঠিক নয় সেটা এখন জেনেছি আমি, যা শেখার বা জানার কথা ছিলো আমার শিক্ষার্জনের শুরুতেই।
এই সব ব্যাপার নিয়ে আমরা এখন আন্দোলন করছি,কথা বলছি, প্রশ্ন তুলছি অথচ এসব বৈষম্য হুট করে বা এক দিনেই কোন মানুষের মনে গেড়ে বসেনি, বরং দিনের পর দিন এটি রোপন করা হয়েছে, যার দ্বারা একজন অন্যজনকে হেয় করে যাচ্ছে, ছোট করে যাচ্ছে ফাজলামো বা মজার ছলে।
কেউ কেউ এসব সহ্য করার ক্ষমতা হারান বা ধৈর্য্যেরও উর্ধ্বে চলে যান।
এর দায় কি শুধুই একজন ব্যাক্তির?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]