November 24, 2024
ফিচার ১মুক্তমত

কুৎসিত মন্তব্য করে নারীকে আটকে রাখা যায় না

সাবরিনা শারমীন বাঁধন।। কিছু মানুষ আছে যাঁদের নামের আগে পরে কোন বিশেষণ দরকার পরে না, তিনি তাঁর গুনেই অনন্য। দেশে বিদেশে এমন অসংখ্য প্রতিভাধর মানুষ আছেন যাঁরা সর্বজনশ্রদ্ধেয়।

কিন্তু সমাজে কোন নারী যদি প্রতিভাধর হন, তবে তাঁকে তাঁর গুনের মূল্য দিতে হয় পদে পদে। কারণ তাঁর প্রতিভা যোগ্যতা আছে। কারণ তাঁর গুণের আলোতে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে, ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ খুব ঝামেলায় পড়ে গেছে। তাই তাঁর পোশাক, চরিত্র, পরিবার নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলে তাঁকে ঘায়েল করবার চেষ্টা করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের লোকজন।

সম্প্রতি বরেন্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন। এই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। শিল্পী সুস্থ হয়ে উঠবেন এমন শুভকামনা জানাচ্ছেন সকলে।

কিন্তু একটা শ্রেণি যারা পুরুষতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, এই চরম দুঃসময়ে তারা বরাবরের মত প্রশ্ন তুলছে শিল্পীর পোশাক নিয়ে, কথা বলছে তার সংগীতচর্চা নিয়ে, প্রশ্ন তুলেছে তাঁর ধর্ম নিয়ে এবং তিনি কেন রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করেন, সেটা নিয়েও। কেন নজরুল সংগীত নয়-  সেটাও তাদের চিন্তার বিষয়! এদের অসুস্থ বিবেকে বুদ্ধিতে এইটুকুই ধরে যে নজরুল সংগীত গাইলে মুসলমান আর রবীন্দ্রসংগীত মানেই হিন্দু। সাম্প্রদায়িকতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অথচ এই দেশকে অসাম্প্রদায়িক দাবি করেন সকলে।

একজন নারী কী পোশাক পরবেন, শাড়ি নাকি প্যান্ট-টপস পরবেন, কপালে টিপ দেবেন কিনা- এই সিদ্ধান্ত প্রতিটি নারীর নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। পরিবারের অবস্থানও নারীর নিজের উপরই বর্তায়। একইভাবে তিনি সন্তান নেবেন কিনা, লালন পালন করবেন কিনা, সেটিও তার নিজের ইচ্ছে ও সিদ্ধান্ত। মনে রাখা জরুরি সন্তান পালন কেবল নারীর একার দায়িত্ব নয়। সেখানে বাবারও দায়িত্ব আছে। পরিবারে একজন বাবা কেরিয়ার নিয়ে আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং আকাশ ছুঁয়ে ফেললে সমাজ সেই বাবাকে বরণ করে ফুলের মালায়, অথচ একজন মায়ের সেই অধিকার নেই! কেন? তিনি নারী বলে? একজন নারী কেন কেরিয়ার নিয়ে ভাববেন না? কেন নারী খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছালে তাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ টেনে হেঁচরে মাটিতে নামাতে চায়? কেন তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ করে? কেন তাঁর পারিবারিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে?

কারণ নারীর সাফল্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঘৃণ্য, অচ্ছুত চোখে দেখে। কারণ নারী এগিয়ে গেলে এই অসভ্য সমাজ নারীকে দমন, পীড়ন করতে পারবে না। কারণ তারা নারীকে কেবল ভোগের সামগ্রী বানিয়ে বন্দি রাখতে চায়। তাদের সম্পত্তি হিসেবে রাখতে আনন্দ পায়। এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খেলা।

সমাজ জানে অথচ মানে না যে, প্রত্যেক নারীর উড়বার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সমাজ নারী জন্মের সাথে সাথেই তার ডানা দুটি কেটে দেয়। তাকে বোঝায়, তুমি মেয়ে এটাই তোমার পরিচয়। মস্ত বড় আকাশটি নারীকে দেখবার সুযোগ তারা দিতে চায় না। এর একমাত্র কারণ, নারী আকাশ দেখে ফেললে তাকে আর শোষণ করা সম্ভব হবেনা।

সফল নারীরা সমাজের এসব কুটিলতার কথা মাথায় রেখেই এগিয়ে যান।

কিন্তু আমার প্রশ্ন হল – রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মতন শিল্পী বাংলাদেশে কয়েকজন মাত্র আছেন। এই স্বল্প সংখ্যক ‘রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা’কে নিয়ে গাত্রদাহ এই মৌলবাদী সমাজের। এই গুটিকয়েক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্য হুমকি। কারণ তাঁরা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু দেশের ৯০ শতাংশ নারী যদি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মতই আত্মনির্ভরশীল, কর্মমুখী, আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী  হতেন তবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কী করত?

নারীকে মানহানিকর মন্তব্য, নিপীড়ন, নির্যাতনের জন্য কঠোরতম আইন এই দেশে পাশ না হলে এবং উপযুক্ত শাস্তি না হলে এই প্রতিহিংসাপরায়ণ সমাজ বদলাবে না। কঠোরতম আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নই হবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে চপেটাঘাত।

পরিশেষে বলি- আপনারা ভুলে গেছেন এটা ষাট, সত্তর বা আশি, নব্বই দশক নয়। এটা ২০২০ সাল। এখন নারী ঘুরে দাঁড়াতে শিখে গেছে। নারীকে যতই আঘাত করেন না কেন তাতে বন্যা’রা থেমে থাকবেন না। তাঁরা প্রতিদিন আকাশ ছোঁবেন।

আপনারা যতই পা ধরে টানাটানি করেন, মনে রাখবেন আমরা নারীরা প্রতিদিন আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো !

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]