November 25, 2024
মুক্তমত

সম্পর্কের খাতিরে বন্ধুত্ব নাকি মানসিক শান্তি?

নাজিয়া হোসেন অভি।। আমরা আমাদের পরিবার পছন্দ করে বেছে নেই না। কিন্তু বন্ধু তৈরি করি নিজেদের পছন্দে। আবার ছোটবেলার বন্ধুদেরও আমরা নিজেরা পছন্দ করি না। আমরা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই বা কাছে পিঠের সমবয়সীদের মধ্য থেকেই গড়ে ওদের শৈশবের বন্ধুত্ব। এই সময়টায় বন্ধুত্ব তৈরি হতে নিজস্ব খেলনা ভাগ করে নেয়া, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, আনুগত্য ছাড়া তেমন কিছুর প্রয়োজন হয়না। বন্ধুত্ব হয়ে যায় বুঝে উঠার বয়স হবার আগেই। তাছাড়া মানুষ হিসেবে যেহেতু আমরা দলবদ্ধভাবে চলতে পছন্দ করি তাই খুব সহজেই বন্ধুচক্র গড়ে ফেলি শিশু কিশোরবেলায়। বন্ধুরা খুব মূল্যবান হয়ে যায় আমাদের জীবনে।

বন্ধুত্বে আনুগত্য খুব জরুরি কিন্তু প্রতিটা মানুষ যেহেতু ভিন্ন প্রকৃতির তাই শৈশব থেকেই বন্ধুচক্রে মানুষগুলো বিভিন্ন অবস্থান নিয়ে দলবদ্ধ হয়। শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ থাকে নেতৃত্বে, কেউ হয় অনুসারী। অনেক শিশুদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও হয়। আর অনুসারী শিশুরা একটা লম্বা সময় পর্যন্ত অন্তত নিজেদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের আগে পর্যন্ত অনুসারীই থেকে যায়।

একসময় ভীষণ গুরুত্ব পাওয়া মানুষগুলো প্রাপ্ত বয়সে বন্ধু সমাজে সাধারণ পর্যায়ে চলে আসে। আর অনুসারী মানুষগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শৈশবের নেতৃত্বের সেই জায়গাটা তাদের আর দিতে পারে না। তারা বন্ধুত্বে সমতা খোঁজে, চায়। তখন এই নেতাস্থানীয় বন্ধুটির মধ্যে যে ধরণের সমস্যা তৈরি হয় তা হল অন্যান্যদের ঠিক মতো বশে না রাখতে পারার সমস্যা । অনেক ক্ষেত্রে এই মানুষগুলো আগ্রাসী হয়ে ওঠে তখন নানা ধরণের দোষারোপ, অন্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে তির্যক মন্তব্য, সামাজিক অবস্থান, শারীরিক গঠন, পরিবারিক টানাপোড়েন, সম্ভব হলে অন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে একজনকে একঘরে করে দেয়ার মতো নানা ঋনাত্মক কাজকর্ম চালাতে থাকে। সবাই ঠিক এই আচরণটি করবে তা নয় কিন্তু কোন কোন মানুষের মানসিক বিকাশ সেই পর্যায়ের হয়না, তারা বিকশিত ও পরিবর্তিত সমতায় বিশ্বাসী বন্ধুটিকে মেনে নিতে পারে না. সুন্দর সম্পর্কটা বদলে যায় মিথ্যার, ঈর্ষার, পরশ্রীকাতরতার আর আঘাতের সম্পর্কে। সেটা হতে পারে উভয় দিক থেকে বা একপাক্ষিক।

ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে শুরু করে মানুষের ব্যাক্তিত্ব বিকশিত হতে শুরু করার প্রথম পর্বেই। বয়সের সাথে সাথে মানসিক পরিপক্কতা, পড়ালেখার পরিধি, কাজের ক্ষেত্র, পারিবারিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যাক্তিত্ব তৈরি করে। মানুষ হিসেবে পছন্দ অপছন্দ তৈরি হয়, নতুন মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়, নতুন বন্ধুত্ব হয়। মানুষ তো প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। গতকালের আমি আর আজকের আমিই এক মানুষ নই, এর মাঝেই জীবনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে কিছু অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে এই নতুন অভিজ্ঞতা, কারো ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান পরিবর্তন জীবনের চড়াই উৎরাই ব্যাক্তিত্বতে নতুন মাত্রা যোগ করে মানুষকে বদলে দেয়। জীবনের এই বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতাগুলোর জন্য কারো জীবন হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত, কেউ হয়তো জীবন নিয়ে হতাশায় ভোগেন। কেউ হয়তো খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারেন না নিজেকে।

বন্ধুত্বের সম্পর্কে নির্ভর করে বিশ্বাস, আস্থা, সহানুভূতি, সততা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমবেদনা,সঙ্গপ্রিয়তা, নিজের যোগ্যতা, অনুভূতি প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা আরো অনেক ধরণের প্রভাবকের উপরে। শৈশবে যে বিশ্বাস আস্থা কিংবা সহমর্মিতা সহজে স্থাপন করা যায়, ব্যক্তিত্ব বিকাশের সাথে সাথে সেগুলোই কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে। বন্ধুত্বের মাঝে স্বার্থ জায়গা করে নিতে পারে। আবার একই ধরণের বিষয়ে আগ্রহ থেকে বন্ধুত্বে আসতে পারে নতুন মাত্রা। কোন কোন বন্ধুত্বের বাঁধন অটুট থাকে, আবার কোন কোন সম্পর্কের গাঁথুনি আলগা হয়ে যায়, কলহ হয়। আবার সম্পর্কটা সেরকম মূল্যবান এবং প্রিয় হলে মানুষ সেই সম্পর্কের কাছে সমস্যা মিটিয়ে নিয়ে আবার ফেরত আসে। শৈশবে কারো সঙ্গ খুব প্রিয় হলেও প্রাপ্তবয়সে সেই মানুষটির সঙ্গ একইরকম ভালো লাগবে এমন নাও হতে পারে। তাই অনেক বন্ধুত্ব টিকে থাকে কোন রকম আকর্ষণ ছাড়াই, ভেতর থেকে সম্পর্কগুলো মৃত কিন্তু দীর্ঘ দিনের বন্ধু বলতে পারার আরামটুকুর জন্য।

বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনটা এমনিতেই ভীষণ চাপের মধ্যে কাটে। পরিবার, সমাজ, সংসার, কাজের নানাবিধ জটিলতার মধ্যে সঠিক বন্ধু বেছে নেয়াটা খুব জরুরি। দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কের খাতিরে কোন বন্ধুত্বকে টেনে লম্বা করার কিছু নেই। সমমনা, সহমর্মী, বিশ্বাসী দু’তিনজন বন্ধুই যথেষ্ট। আর তাছাড়া বন্ধুত্বসহ পৃথিবীর যে কোন সম্পর্কেই সম্মান থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। কারো কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অসম্মানিত হয়ে সম্পর্কের খাতিরে সম্পর্ক বয়ে চলাটা কোন কাজের কথা নয়। আবার অসম্মানকারী মানুষটাকে পাল্টা আঘাত করারও কোন মানে হয় না। সেক্ষেত্রে নিজেকেই একই পর্যায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাই এই ধরণের পরিস্থিতিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে- যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয় তাহলে বন্ধুটির সাথে কথা বলে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা যেতে পারে, তার কথা শোনার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা যেতে পারে। আর এসব পদক্ষেপে কাজ না হলে নিজের চারপাশে এক ধরণের বলয় বা দূরত্ব ও তৈরি করা যেতে পারে যেন যে কোন ঋনাত্মক পরিস্থিতি থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু সব ধরণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এই ধরণের বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়াই বাঞ্চনীয়। সেক্ষেত্রে নীরবতার থেকে বড় কোন উত্তর নেই ভেবে নেয়া যেতে পারে।

 

নাজিয়া হোসেন অভি: রিস্ক এনালিস্ট, ওয়েলস ফার্গো ব্যাঙ্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]