September 20, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

হরর নাকি ফেমিনিস্ট ড্রামা- বুলবুল আসলে কী?

সাবিহা ইশরাত জাহান স্টেলা।। বুলবুল- করোনাকালে প্রেক্ষাগৃহের বদলে স্ট্রিমিং সাইটে মুক্তি পাওয়া ভারতীয় সিনেমা, যাকে মুক্তির আগে প্রচারের সময় ভৌতিক অথবা হরর ড্রামা বলা হলেও, সপ্তাহ পেরুনোর পর একে বলা হচ্ছে ফেমিনিস্ট ড্রামা। কেন এই আখ্যা বা ব্যাখ্যার বদল, সিনেমার কাহিনী, আখ্যা বদলের ইতিবাচক দিক এবং ফেমিনিস্ট মুভিটির গল্প সংক্রান্ত মনের কথাই লিখতে বসা।

ছবির গল্পে যাওয়ার আগে কিছু রেফারেন্সসহ সিনেমাটি নিয়ে দু’একটি মন্তব্য জেনে নিই চলুন। পরিচালক অনভিতা দত্ত ও প্রযোজক আনুশকা শর্মার ছবি ‘বুলবুলে’র ব্যপ্তিকাল ৯৪ মিনিট। ছবিটি নিয়ে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে ‘আ পাওয়ারফুলি ফেমিনিস্ট, রিভিশনিস্ট টেল’ বাংলা করলে যার অর্থ হতে পারে, শক্তিশালি নারীবাদ ও সংশোধনবাদী গল্প। হাফিংটন পোস্টের ভাষ্যে, ছবিটি অবশ্যই শক্তিশালী কোন বার্তা বহন করছে। আর ওয়াইওন নিউজের মতে, ভৌতিক আবহে গুরুত্বপূর্ণ বার্তার ছবি এই বুলবুল।

এবার তবে গল্পে ফেরা যাক। সেই আঠারশ’ সালের গোড়ার দিকের কথা। সতীদাহ বা গৌরিদানের মতো শব্দগুলো তখন সমাজে বেশ প্রতাপের সাথেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। যারা ভারতীয় বাংলা উপন্যাস পড়ার অভ্যাস রাখেন, তারাও বহু বছর আগে আশাপূর্ণা দেবীর বিখ্যাত উপন্যাস প্রথম প্রতিশ্রুতিতে গৌরিদানের বিস্তারিত বর্ণনা জেনে থাকবেন। আর ঐতিহাসিক বা তথ্যবহুল অসংখ্য লেখায় তো রয়েইছে। তো, কন্যাদায়গ্রস্ত কোলকাতার এক বনেদী পরিবার ৫ বছরের শিশু বুলবুলকে চারগুণ বয়সী জমিদারের সাথে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় জমিদার বাড়িতে।

বুলবুলের বুঝতেই অনেকটা সময় লেগে যায় যে, পালকিতে চড়ে খেলতে খেলতে আসা ছোট্ট দেবরটি তার বর নয়। এক পর্যায়ে বোঝা যায়, জমিদার বা ঠাকুরের পাগল জমজ ভাইয়ের বউকেই এতোদিন যাবৎ শারীরিক চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করছিলেন সেই বড় ঠাকুর। যা জারি থাকে বুলবুল বড় হওয়া পর্যন্ত।

আপত্তি ছিল না সেই মেজ বউয়েরও। কারণ, পাগল স্বামীর সাথে ঘর করে তার অবস্থা এমনিতেই কাহিল। আর সেই ফাঁকে বুলবুল বড় হচ্ছিলো ছোট দেবর বা প্রায় সমবয়সী সত্যর সাথে, যার সাথে গড়ে ওঠে অটুট বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু কলকাঠি নেড়ে কোনভাবে বড় ঠাকুর বা বুলবুলের স্বামীকে বোঝানো হয় যে, সত্য’র সাথে বুলবুলের প্রেম চলছে। দোর্দন্ডপ্রতাপ ঠাকুর তখুনি ছোট ভাইকে বিলেত পাঠান।

এতেই ক্ষান্ত হননা, লোহার দণ্ড দিয়ে মেরে বুলবুলের দুটো পায়ের হাড় প্রায় গুড়ো করে দেন। মৃতপ্রায় শয্যাশায়ী চিকিৎসাধীন বুলবুলকে ধর্ষণ করে সেই পাগল মেজ দেবর। বুলবুলকে বোঝানো হয় যে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে নারীদের ওপর এ ধরণের ঘটনা খুবই স্বাভাবিকভাবে নেয়া উচিত। তবেই সে সুখি হতে পারবে।

একটু পেছনে ফেরা যাক। সেই গ্রামে একটা গল্প ছিলো, শাকচুন্নী বা পেত্নির গল্প। আসলে তখন থেকেই বা তারও বহু বছর আগে থেকে যে কোন নেতিবাচক কিছুর সাথে নারীকে তুলনা করা হত। সে ব্যাখ্যায় না হয় পরে গেলাম। উল্টো পায়ের সেই পেত্নি নাকি রাস্তায় কাউকে পেলে হামলা চালায়, যা অনেকদিন পর্যন্ত গল্প হিসেবে ঘুরে ফিরলেও, এক সময় সত্যি ঘটনায় পরিণত হয়।

দেখা যায়, সেই পেত্নি বা শাকচুন্নী বেছে বেছে পুরুষদেরই মারছে। তবে সব পুরুষকে না। যারা বউ পেটায়, নারীদের ওপর অত্যাচার করে, শিশুদের ভোগের বস্তু বানায়, ধর্ষণ করে- তাদেরই ওই পেত্নির শিকার হতে হয়। বাদ যায় না বুলবুলের সেই পাগল ও ধর্ষক দেবরও।

আসলে স্বামী পা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার পর, বুলবুলই পরিণত হয়েছিলো ওই উল্টো পায়ের পেত্নিতে। প্রতিবাদের আগুন জ্বলছিল বহুদিন ধরে। তাই সমাজ যেহেতু পাল্টাবার কোন লক্ষণ নেই, সে নিজেই এসব নোংরা, ঘোরতর অপরাধীদের শাস্তি নির্ধারণ করছিল।

বুলবুল সিনেমাটি কেন ফেমিনিস্ট ড্রামার আখ্যা পেল? ট্রেলারে তো এরকম কোন আভাস দেননি এর পরিচালক বা প্রযোজক। তবে কি আসলেই ভারতবর্ষের দর্শককুল বোদ্ধা হয়ে উঠছে? হতেই পারে, কারণ কোন ধরণের তথাকথিত খোলামেলা দৃশ্য এতে নেই। নেই কোন বাহারি গান, যাতে বরাবরই নারীকেই ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখিয়ে ঐশ্বরিক শান্তি লাভ হয়। নারীও সেসব গানেই নেচে আসছে যে কোন আসরে বহু বছর ধরে।

আর এখানেই বাজিমাত করেছেন এর গল্পকার ও পরিচালক। পুরোনো আবহ তুলে এনে বোঝাতে পেরেছেন, কোনকালেই আসলে নারীকে আটকে রাখা যাবে না। তাকে শাকচুন্নী, পেত্নি, পতিতা বা হালের বসের সাথে শুয়ে পদ আদায় করা কর্পোরেট নারী বলো আর যত পারো নতুন বিশেষণে ভূষিত কর, নারী তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে তবেই ক্ষান্ত হবে।

বুলবুল ছবির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তার কথা বলি। ডাক্তারের সাথে একই চেয়ার বা সোফায় বসে গল্প করছেন ঠাকুর বাড়ির বড় বউ বুলবুল। ব্যবসায়িক কাজে তার স্বামী তখন বহু দূরে। সেই দৃশ্য দেখে তাই বেশ ক্ষেপে ওঠে তার ছোট্টবেলার বন্ধু দেবর। কেন দূরত্ব মানা হয়নি বা ডাক্তারের সাথে পর্দা রেখে দেখা করা হয়নি তা নিয়ে বুলবুলকে কথা শোনায় সে। কিন্তু এদের অন্দরমহলেই ঘটছে নোংরা অশ্লীল সব অপকর্ম।

বুলবুলরা ফিরে ফিরে আসে যুগে যুগে কালে কালে। যতই দমন করা হোক, সমাজের তুচ্ছ আদিম সব নিয়মের বেড়াজালে আটকানো হোক অথবা পুঁজিবাদের সুবাসিত মোড়কে বেঁধে ফেলা হোক, সময়মতো সে তার প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দমন পীড়নের নানা কৌশল আর নারীর আত্মজাগরণের কাহিনীটি দারুনভাবে তুলে আনতে সফল বুলবুল, আর তাই হয়তো ‘হরর মুভি’ থেকে ‘ফেমিনিস্ট ড্রামা’র তকমা লাভ করতে সিনেমাটির বেশি বেগ পেতে হয়নি।