শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন, চিকিৎসক হবার লড়াই
নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব-০৯
শারমিন শামস্।। ইতিহাসে এমন কিছু কিছু সমাজেরও উদাহরণ আছে, যারা নারীশিক্ষা নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলেনি। খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে প্রাচীন গ্রীসের স্পার্টা নগরে নারী পুরুষ একইরকম শিক্ষাগ্রহণ করত। খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত ভারতের মেয়েরা স্বাধীনভাবে লেখাপড়ার সুযোগ পেত। যদিও এ ধরণের উদাহরণ খুবই কম ছিল। প্রাচীন এথেন্সের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কালেভদ্রে এক দু’জন নারী পড়তে আসত। আর এদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছিল হাইপ্যাশিয়ার মত গণিতজ্ঞ।
মধ্যযুগে ইউরোপে দরিদ্র ঘর থেকে আসা কোন শিশুই শিক্ষার সুযোগ পেত না। বরং তাদের অল্প বয়স থেকেই রোজগারে নামতে হত। আর সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির ছেলে শিশুদের জন্য বাসায় রাখা হত গৃহশিক্ষক অথবা তারা গ্রামার স্কুলে যেত। ধনী পরিবারের মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল। বড়জোর তারা কনভেন্টে পড়তে যেত। এসব কনভেন্টে পড়া বহু নারীই পরবর্তীতে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছিলেন।
এই যে শিক্ষার সমান সুযোগ না থাকা, এর বিরুদ্ধে নারীরা কিন্তু কোনোকালেই চুপ করে ছিলনা। ইতালির Christine de Pisan (১৩৬৪-১৪৩০) নারীশিক্ষার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। ফরাসি লেখিকা Marie Le Jars de Gournay ১৬২২ সালে Equality between men and women শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে তিনি বলেন, নারীর পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ লেখাপড়া শিখতে না পারা। জার্মানিতে জন্ম নেয়া ডাচ ভাষাবিদ, কবি, শিল্পী Anna Maria Van Shurman ১৬৩৮ এ লেখেন- পান্ডিত্যের জীবন নারীকে মানায়। তিনিই ছিলেন প্রথম নারী যিনি ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, যদিও ক্লাস লেকচারের সময় তাকে পর্দাঘেরা একটা জায়গায় বসতে হত।
আঠারো শতকে ফরাসী বিপ্লবের সাথে ইউরোপে প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সময় নারী অধিকার আন্দোলনও একটি সাংগঠনিক চেহারা নিয়ে এগোতে থাকে। সে সময় অনেকেই সমাজ কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। নারীরাও কথা বলছিলেন সমতা আর স্বাধীনতা নিয়ে। ফরাসি নারীবাদী Olympe de Gouges (১৭৪৩-১৭৯৩) নারীশিক্ষা না থাকার কারণে কী কী সমস্যা তৈরি হয় সে বিষয়ে একটা পুস্তিকা আকারে লেখেন। নাম দেন – Declaration of the rights of woman (১৭৯১)। এর পরের বছরই মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের Vindication of the rights of woman প্রকাশিত হয়, যেখানে মেরি বারবার নারী শিক্ষার কথা বলেছেন, সমাজকে তাগাদা দিয়েছেন শিক্ষায় মেয়েদের সমান সুযোগ দেবার জন্য। একই তাগাদা এসেছে হ্যারিয়েট টেইলর মিল, হ্যারিয়েট ম্যাটিনোর কলম থেকেও।
ইউরোপ ও আমেরিকায় শিক্ষার দাবিতে নারী আন্দোলন চলে উনিশ শতক জুড়ে। শেষে বিশ শতকের গোড়ায় এসে নারী শিক্ষার জন্য আইন হয়। কিন্তু সেটি শুধু ইউরোপ আর আমেরিকার অর্জন। পুরো পৃথিবী তখনও পিছনে পড়ে আছে। আজো আছে। অথচ শুরুতেই যেমন বলেছি, মেয়েরা কিন্তু শিক্ষার দাবি নিয়ে কখনোই চুপ করে ছিল না। শতশত বছর আগেই সারা পৃথিবীতে শিক্ষার অধিকারে লড়ে গেছে নারী। এই উপমহাদেশে ১৮৮০ সালে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়া সেইসব নারীর একজন। তার লড়াই ছিল একাকী নিঃসঙ্গ।
বেগম রোকেয়ার সাফল্য এখানে নয় যে, তিনি বাংলার মুসলমান মেয়েদের জন্য একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কারণ রোকেয়ার জন্মের ত্রিশ বছরেরও বেশি আগে বেথুন স্কুল স্থাপিত হয়ে গেছে। তার জন্মের সাত বছর আগে কুমিল্লায় হয়েছে ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে হচ্ছিল আরো কিছু স্কুল। এরপরও রোকেয়ার অবদান বিশেষ, এরপরও রোকেয়া অগ্রগামী কারণ তিনি নারীর দাস জীবনের অবসানের জন্য শিক্ষাকে একটি উপায় বা হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। রোকেয়ার মূল লক্ষ্য ছিল নারীমুক্তি। নারীশিক্ষা ছিল তার সেই লক্ষ্য অর্জনের অস্ত্র।
রোকেয়াকে নিয়ে লিখতে গেলে একটি আস্ত অধ্যায় প্রয়োজন। পরে রোকেয়াকে নিয়ে বিশদ আলোচনায় আমরা যাব। তবে এই মুহূর্তে যখন আমরা পশ্চিমের নারীবাদ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের বা ওয়েভের কথা লিখছি, শিক্ষার জন্য পৃথিবীর অন্য দেশে নারীর লড়াই বর্ণনা করছি, তখন সেই একই সময়কালে উপমহাদেশে বেগম রোকেয়ার সংগ্রামের উল্লেখ না রাখলে পুরোটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যদিও পশ্চিমের সেই আন্দোলনের সাথে রোকেয়ার সংযুক্তি সে অর্থে তৈরি হয়নি। রোকেয়া থেকে গেছেন নিজস্ব পরিসরে একাকী যোদ্ধা হয়ে, রক্তাত্ত হয়েছেন একাই, ফের উঠে দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে ভর রেখে।
একটি রক্ষণশীল পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন একজন কথাশিল্পী, চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে। লিখেছেন ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লেষাত্মক গদ্য। বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন, যুক্তিবাদী ছিলেন, কৌশলীও ছিলেন। এই সবকিছুর পরেও যা ছিলেন তা হল চরম প্রতিবাদী এক সত্ত্বা। ধর্ম, লোকাচার, সমাজ, রীতি, নীতি আর পুরুষতান্ত্রিক প্রথার বিরুদ্ধে যা লিখেছেন, সেই ১৮ শতকে এইসব লেখা কোন নারীর কলম দিয়ে বেরিয়েছে তা ভাবতে অকল্পনীয় লাগে।
জীবনসঙ্গী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া অর্থে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন বেগম রোকেয়া। কিন্তু পারিবারিক কারণে ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নতুন করে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা একশ পেরিয়ে যায়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে এই স্কুলের কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। সাথে চলে সাংগঠনিক ও সামাজিক কাজ আর সাহিত্য চর্চা। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় নারী অধিকার বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেন। রোকেয়া তার নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার মতিচূর প্রবন্ধসংগ্রহের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে।
সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদিও রোকেয়ার রচনা। এর মধ্যে সুলতানার স্বপ্ন নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত হয়।
চিকিৎসক হতে পারার অধিকার
১৫৪০ সালে ব্রিটেনের বারবার সার্জন এবং রয়েল কলেজের সার্জনরা নারীদের প্রতি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে তারা যেন সার্জন হবার চিন্তাও না করেন। ১৮৫৮ সালে ইউকে’র চিকিৎসা আইন মেয়েদের চিকিৎসক হওয়ার বিষয়টি নিষিদ্ধ করে দেয়।
উনিশ শতকে চিকিৎসা বিজ্ঞান ছিল পুরুষের দখলে। নারী বড়জোর আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দিতে পারতো, নয়তো হতে পারত নার্স আর ধাত্রী। প্রথম পর্যায় বা ওয়েভের নারীবাদীদের আন্দোলনের অন্যতম ইস্যু হয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানে নারীর অধিকার আদায়। তখন নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছে, অন্যান্য পেশাও বেছে নিচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসক হবার ক্ষেত্রে নারীকে তখনও আটকে রাখা হয়েছে।
নারী চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়বে এবং প্রশিক্ষণ নেবে, এই অধিকার আদায়ের আন্দোলন সহজ ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে সময় একজন নারীকে চিকিৎসক হতে পুরুষই শুধু বাধা দেয়নি, নারীরা নিজেরাও একজন নারীকে চিকিৎসক হিসাবে প্রথমে মেনে নিতে পারেনি।
এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল (১৮২১-১৯১০)
ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে জন্ম নেয়া এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলই প্রথম তর্কটা তুললেন। বললেন, একজন নারী চিকিৎসকের হাতেই একজন নারী রোগীর চিকিৎসা সবচেয়ে ভালো হতে পারে। মৃত্যপথযাত্রী নারী বন্ধু তাকে বলেছিলেন, একজন পুরুষ চিকিৎসকের কাছে সব কথা বলতে তিনি বিব্রত বোধ করেন। এটা এলিজাবেথকে ভাবাচ্ছিল। এরই মাঝে মানবদেহ নিয়ে পড়াশোনাও করছিলেন। ঠিক করলেন চিকিৎসক হবেন। ফিলাডেলফিয়ার মেডিকেল স্কুলে আবেদন করলেন। হল না। এদিকে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল The lancet-এ একটি প্রবন্ধ ছাপা হল, যা সমাজের মানসিকতার গানটিই গাইছিল। তাতে বলা হয়েছিল, নারীরা লৈঙ্গিকভাবে, মানসিকভাবে এবং সাংবিধানিকভাবে একজন চিকিৎসক হতে অক্ষম।
সমাজের এটা ভয়ও ছিল যে, নারী চিকিৎসকরা পুরুষ চিকিৎসকদের দক্ষতা আর উচ্চ অবস্থানকে নিচে নামিয়ে আনতে পারে।
এরকম একটি সমাজের ভেতরেই এলিজাবেথ আবেদন করে যেতে লাগলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়বার সুযোগের জন্য। অবশেষে সুযোগ পেলেন নিউইয়র্কের জেনেভা মেডিকেল কলেজে পড়বার। ১৮৪৯ সালে গ্র্যাজুয়েট হলেন সেখান থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনিই প্রথম নারী যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিলেন। কিন্তু যুদ্ধ সবে শুরু। পুরুষ সহকর্মীরা অসহযোহিতা করল তো বটেই, নারী রোগীরাও বেঁকে বসল। কিন্তু থামিয়ে রাখা যায়নি তাকে। ইউরোপে গিয়ে আরো পড়ালেখা করলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে। অভিজ্ঞতা হল। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের একটি বস্তি এলাকায় খুললেন নারী ও শিশুদের জন্য হাসপাতাল। ১৮৬৮ সালে সেখানে নারীদের জন্য মেডিকেল স্কুল চালু করলেন। ১৮৬৯ এ ইউকে’তে ফিরে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতে থাকেন। নারীকে চিকিৎসক হবার ক্ষেত্রে পুরুষের সমান সুযোগ দেয়া হোক, এই মর্মে এলিজাবেথ তার ক্যাম্পেইন জারি রেখেছিলেন। পাশাপাশি ওষুধের মান বাড়ানো, স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন, পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করতে থাকেন। তিনি নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের সাথেও ছিলেন।
অবশেষে ১৮৭০ এ এডিবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগে নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেয়া শুরু করে। ১৮৭২ এ নারীদের জন্য লন্ডনে নতুন হসপিটাল তৈরি হয়। ১৮৭৬ এর পরে নতুন চিকিৎসা আইনে ব্রিটিশ চিকিৎসক কর্তৃপক্ষ নারী পুরুষ উভয়কেই লাইসেন্স দেয়া শুরু করে। ১৮৯২ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে নারী চিকিৎসকদের সদস্য হিসেবে নেয়া শুরু হয়।
[চলবে]