বডি শেমিং: চেহারা আপনার, হাহুতাশ অন্যদের!
তানজিয়া রহমান।। প্রায় সব মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময় বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছে। সমাজ থেকে তো হয়েই থাকে কেউ কেউ পরিবার থেকেও হয়। কারো দৈহিক আকার, আয়তন বা গড়ন নিয়ে করা প্রকাশ্য সমালোচনা বা মন্তব্যের নামই ‘বডি শেমিং’। ছেলে মেয়ে সবাই বডি শেমিংয়ের শিকার হয়। কিন্তু মেয়েরা তুলনামূলক বেশি। কারো কারো স্বভাব থাকে কাউকে দেখলেই খুঁত বের করার। তারা মুখের ওপর কিছু একটা বলে বসে, কিন্তু এর পরিনতি ভয়াবহ হতে পারে তা চিন্তা করে না।
অল্প বয়সেই এর শিকার হয় অনেকে। এই যেমন অনেক বাচ্চার সামনের দাঁত বড় হয়। এটা নিয়ে শুরু হয় দাদি নানিদের হাসি, ঠাট্টা।
“তোর সামনের দাঁত তো কোদালের মত।”
“হাসলে তো দাঁত ভেটকায়া পরে।”
এই যে দাঁত নিয়ে বড়দের মজা করা সেই দাঁত কিন্তু বড় হলে ঠিক হয়ে যায়। বাচ্চাটা বড় হওয়ার সাথে সাথে, মুখ বড় হওয়ার সাথে সাথে দাঁত স্বাভাবিক হয়ে যায় কিন্তু সেই যে ছোটবেলার কথা, সেটা কিন্তু মনে থেকেই যায়। অনেক বাচ্চা দাঁত বড় শুনতে শুনতে একসময় হাসতে চায় না, কারো সাথে কথা বলতে চায় না। একা সময় আয়নায় নিজেকে দেখে হয় তো কাঁদে।
উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে বডি শেমিংয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বন্ধুবান্ধব এক সাথে বসে ইয়ার্কি করে নানা কথা বলে।
“কোন চালের ভাত খাসরে?”
“তুই এক হাতি, তোর বর/বউ হবে আরেক হাতি।”
“তুই কিছু খাস না? এত শুকনা কেন? বাতাসে উড়ে যাবি।”
“তোর মা বাবা কে কালো/ফর্সা? তুই কার মত হইছিস?”
“তোর বোন/ভাইয়ের গায়ের রং কি তোর মত কালো?”
এই কথাগুলো খুব কমন। এইসব শুনে অনেক ছেলে-মেয়ে বন্ধু বানাতে ভয় পায়। কারো সাথে মিশতে চায় না। নিজেকে আলাদা করে ফেলে। এই বয়সটাতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। অনেকে এই পথটাও বেছে নেয়।
কলেজ জীবনে দেখা যায় চারদিক থেকে শারীরিক গঠন নিয়ে এত এত কথা শোনার পরে মনের মধ্যে কাজ করে নিজেকে পরিবর্তন করার। এর মধ্যে আছে রং ফর্সা করা। কোকড়া চুল স্ট্রেইট করা। নিজেকে স্লিম দেখাতে না খেয়ে থাকা যার কারনে অনেক সময় পুষ্টিহীনতায় ভোগে। আরো আছে নাক, ঠোঁট, চোখের গড়ন পরিবর্তন করতে সার্জারি। ব্রেস্ট বড় করার ক্রিম নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম, কোরিয়া, ভিয়েতনাম অনেক মা মেয়ের জন্মদিনে উপহার হিসেবে প্লাস্টিক সার্জারি করান।
বয়স্করা কি বাদ যান? না, যান না। অনেককেই শুনতে হয়- “বয়সের তুলনায় দেখতে আরো বয়স্ক লাগছে।”
“যৌবনে কি সুন্দর ছিলেন এখন আর সেই সুন্দর নেই।”
“চুল পড়ে যাচ্ছে?”
“চামড়ায় ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে?”
এবার আমার কথা বলি। আমার স্কিনে দাগ আছে যা আমি বাদে বহু মানুষের মাথা ব্যাথার কারণ। ব্যাপারটা এমন যে মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। আমার এই দাগ নিয়ে চিন্তা করে আমার আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষক, চেনা-অচেনা মানুষও। “তোমার এই দাগের জন্য ডাক্তার দেখাও নাই? কী ক্রিম লাগাও? আমার অমুক এইটা মাখে। তুমিও মাখো। গায়ের রং উজ্জ্বল, যদি দাগ না থাকতো!” এমন শত শত চিন্তা। ছোটবেলায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমিও চিন্তা করতাম, কেন আমার এই দাগগুলো? আমার অনেক টাকা হলে এর চিকিৎসা করাবো। কিন্তু এখন আর চিকিৎসার চিন্তা করি না। কারণ ইন্টারনেট ঘেটে দেখিছি এটা জেনেটিক। এর একটাই চিকিৎসা লেজার সার্জারী। যা ব্যয়বহুল। কোনো প্রয়োজন নেই এত এত টাকা খরচ করে সার্জারি করানোর। সার্জারির পরে আমি সুফল না পেয়ে হিতে বিপরীত কিছু হতে পারে। আমি নিজেকে ভালোবাসি। আমি যেমন দেখতে তেমনটাকেই ভালোবাসি। এখন কেউ এই ব্যাপারে বললে এক কানে শুনে অন্য কানে বের করি। কাউকে বলি, ভাবতে হবে না আমি এমনই ঠিক আছি।
বডি শেমিং এর কারণে অনেক মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে। অনেকে সব কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। অনেকে আত্মহত্যা করে। কেউ কারো শারিরীক গঠন বা গড়ন নিয়ে কথা বললেই তার গড়ন পরিবর্তন হবে না। কিন্তু যাকে বলা হবে সে কষ্ট পাবে। কাউকে সুন্দর না বললেও অসুন্দর বলে কষ্ট দেয়া কি খুব প্রয়োজন? যেটা জন্মগত বা ন্যাচারাল সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে? বিষয়টা এমনভাবে তুলে ধরা হয় যে- তুমি সুন্দর না, গায়ের রং ফর্সা না, চোখ ছোট, ঠোঁট বাকা, চুল কোকড়া, বেটে বা লম্বা তাই তোমার জীবন শেষ। তুমি পড়াশোনা করে লাভ নেই, তোমার কোনো কাজ হবে না, কেউ তোমাকে বিয়ে করবে না, তুমি পরিবারের বোঝা, বিয়ে হলেও সারাজীবন কথা শুনতে হবে, ভালো বর/বউ পাবা না, পেলেও যৌতুক লাগবে।
এসব বাদ দেন। হাহুতাশ করে কাউকে কষ্ট দেয়ার অধিকার আপনার নেই। আর হ্যা, শেমিং এর শিকার হওয়া ব্যাক্তির পরিবারের সাপোর্ট অনেক প্রয়োজন। তাই পরিবার থেকে অন্ততপক্ষে রেহাই দিয়ে কাছে টেনে নিন। যে যেমন তাকে সেভাবেই ভালোবাসতে শিখুন।
যে যেমনই দেখতে হোক সে জীবনে কি করেছে সেটাই আসল। যার দ্বারা সমাজের ক্ষতি হবে না, কেউ হয়রানির শিকার হবে না সেটাই তো সুন্দর। দেখতে কেউই নিখুঁত না। একজনের কাছে যে সুন্দর অন্যজনের কাছে সে সুন্দর নাও হতে পারে। সুন্দরের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। আর প্রত্যেক মানুষ আলাদা , তাই, ‘ওর মত হতে পারলাম না’- এই দুঃখ করাটাও অযৌক্তিক। নিজের কাছে নিজেকে সুন্দর মনে করতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে, তাহলে একসময় মানুষ ক্লান্ত হয়ে অন্যের গড়ন মাপা বন্ধ করবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]