“ইউ নিড টু বি রেইপড”
শাহাজাদী বেগম।। ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখার পর থেকে সারাটা দিন অস্থির হয়ে আছি। প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রতিবাদ না করা পর্যন্ত কষ্টটা কমছে না। পোস্টটার মধ্যে অনেকগুলো বিষয় ছিল। প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কোন আঙ্গিক থেকে লিখবো! আমি একজন নারী সেই দৃষ্টিকোন থেকে? দুজন কন্যা সন্তানের মা হিসাবে? শিশু যৌন নিপীড়ন নিয়ে? মেডিক্যাল এথিকস নাকি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারের ভিত্তিতে? আমি সূক্ষ অনুভূতির মানুষ। তাই যতবারই লেখাটা পড়ছি, ততবারই নিচের দুটো লাইনে এসে আটকে যাচ্ছি। রাগে ঘৃণায় গা রিরি করছে।
“এইসব মেয়েদের হাজবেন্ড একটু জংলি টাইপের হওয়া উচিত, যাতে তারা একবারে রেইপ করে ফেলে। কারন এই মেয়েরা পারমিশন দিতে চায়না যেহেতু ওদের সেক্সের সময় ব্যাথা লাগে। সো একবারে রেইপ করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।” অভিযোগ এসেছে এই কথাগুলো বলেছেন ডাঃ কাজি শামসুন্নাহার নামে একজন গাইনি চিকিৎসক তার ২১ বছর বয়সী অবিবাহিত রোগীকে। তিনি গাইনোকোলোজিস্ট হিসাবে দেশের আন্তর্জাতিকমানের বেসরকারি হাসপাতাল স্কয়ারে কর্মরত। সেখানেই রোগীর সমস্যা দেখার সময় এই কথাগুলো বলেন বলে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসারা তাসনিম বুশরা রোববার রাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেছে।
শুধু এই কথাগুলো আমি কয়েকবার পড়লাম, মনে মনে পড়লাম, মুখে উচ্চারণ করে পড়লাম এবং চিৎকার করেও পড়লাম। প্রতিবারই আমার অনুভূতি ভিন্ন রকম। মনে মনে পড়ার সময় মনে হচ্ছিল শ’খানেক মানুষের মাঝে কোন এক লোলুপ দৃষ্টি মেয়েটিকে গিলে গিলে খাচ্ছে। মেয়েটি ভয়ে ঘৃণায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে। উচ্চারণ করে পড়ার সময় আমার মনে হলো কিছু কিছু শব্দ যেমন “হাজবেন্ড একটু জংলি টাইপের” “একবারে রেইপ করে ফেলে” “সেক্সের সময় ব্যাথা লাগে” “একবারে রেইপ করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে” আমার কানে লাগছে; শুধু তাই নয় কথাগুলো উচ্চারণ করার সাথে সাথে ঠিক ঐ রকম একটা ফিজিক্যাল ফোর্স আমি দৃশ্যকল্পেও দেখতে পেলাম। কানে লাগা শব্দ আর দৃশ্যকল্প মিলে একটা বিকৃত, গা গোলানো অনুভুতি দিলো। এই কথাগুলো ধর্ষণের চেয়ে কোন অংশে কম যন্ত্রণার নয়।
ডাঃ কাজি শামসুন্নাহার একাধারে একজন ডাক্তার, একজন গাইনোকোলওজিস্ট এবং একজন নারী। উনি একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালে কর্তব্যপালনকালে রোগীর সাথে এই কথাগুলো বলেছেন। এগুলো মেডিক্যাল এথিকসের বাইরে। ডাক্তারের কাছে গেলে কেইস হিস্ট্রিতে লেখা থাকে জেন্ডার এবং বৈবাহিক অবস্থা। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তবুও মুখে একবার জিজ্ঞেস করে নেন বিবাহিত কিনা। তারপরেও একজন ডাক্তারের ৫-৬ বার “বিবাহিত কিনা, বিয়ে ঠিক হয়েছে কিনা “ জিজ্ঞেস করা এবং “একটা মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি অথচ সে তার যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন ভাবতেই পারছিনা। ভাগ্যিস আমি করোনাতে মরিনি, নইলে এমন মজার ঘটনা দেখতেই পেতাম না” “ আমার শারিরিক এই সমস্যাটি নিয়ে কারো সাথে কথা বলা উচিত নয়, এতে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে” নিজেই শরীর সম্পর্কে সচেতন হওয়া মানে অত্যাধুনিক হবার চেষ্টা করা”- এমন মন্তব্য করাও নীতি বহির্ভূত ।
আমাদের দাদী নানীদের যুগে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের কথা মুখে আনাও পাপ ছিল। সময়ের সাথে , পাশ্চাত্য শিক্ষার ছোঁয়া এবং সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে মাধ্যমিক থেকেই এখন শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে ট্রেনিং, পিয়ার এডুকেশনের মাধ্যমেও ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই শিক্ষার গুনগত মান অনুমান করা যেতে পারে। এখনো কতটা পিছিয়ে আছি আমরা যে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞও সেসব শিখতে পারেননি!
আমাদের দেশের নারীরা নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে। এরা নিজের শরীরকে সবচেয়ে কম চেনে। বিউটি পার্লারের বদৌলতে যতটুকু বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিষয়ে যত্নবান ততটা ভিতরের সুস্থতা সম্পর্কে নয়। তার উপর সেটা আবার যদি হয় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য তাহলে তো কথাই নেই। লজ্জা, সংকোচ, উচিত-অনুচিতের বেড়াজাল পেরিয়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়। এছাড়াও আছে শারীরিক গঠনে ভিন্নতা। নারীর প্রজনন অঙ্গের বেশিভাগটাই থাকে শরীরের ভেতরে, কাজেই সেটির পুরোপুরি সুস্থতা বা যত্ন বাইরে থেকে নেওয়া সম্ভব হয় না। অথচ সুস্থ গর্ভধারনের জন্য মেন্সট্রুয়েশন থেকে শুরু করে পুরো প্রজননতন্ত্রের যত্ন নেওয়া খুব জরুরি।
নিজের শরীরের যত্ন নেবার দায়িত্ব নিজের আর সেটির জন্য বিবাহিত, অবিবাহিত কিংবা শারীরির সম্পর্ক হয়েছে কি হয় নি সেটি কখনোই বিবেচ্য কোন বিষয় নয়। যার শরীর সে নিজে নিজের ইচ্ছেমত, নিজের প্রয়োজনমত যত্ন নেবে।
স্কয়ার হাসপাতালের ফেইসবুক পেইজে সোমবার সন্ধ্যায় চিকিৎসক ডা. কাজী শামসুন নাহারের একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, “রোগী আমার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মনগড়া একটি অনৈতিক ব্যাখ্যামূলক অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা কোনোভাবে কাম্য নয়।”
আমি জানি না, একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মনগড়া গল্প প্রকাশ করে একটি ২১ বছরের বাচ্চা মেয়ের কী উপকার হবে! কেনই বা সে এটি করবে! নারী যৌন হয়রানি বা অন্য কোন হয়রানির শিকার হলেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অনেককেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু এই অভিযোগটি মোটেই কোন লঘু অভিযোগ নয়। অবশ্যই এর যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত। এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেয়া প্রয়োজন।
একজন নারীকে সারাজীবনে কতবার, কতজনের কাছে, কতভাবে ধর্ষিত হতে হয় নানাভাবে! এমন কি নারীর কাছে, নারী ডাক্তারের কাছেও… নারীর কি তবে মুক্তি নেই?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]