September 20, 2024
সাহিত্যগল্প

ঘিনঘিন

আলীয়া তামজিদা কান্তি।। শাফিয়া রহমানের মনে হচ্ছে দেশের সব পাখি এসে তার চারপাশে জড়ো হয়ে কোরাস গলায় ডাকাডাকি করছে; দুয়েকটা পাখি কানের ভেতরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। লাঠি দিয়ে তাড়াতে গিয়েই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। বুঝলেন অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজছে। এত সকালে কে এলো আবার? মেঝেতে শোয়া ফুলীর মাকে ঝাঁকুনি দিয়ে তুলে পাঠালেন মূল দরজায়। তক্ষুনি মনে পড়লো কার আসার কথা। যার জন্যে তীর্থের কাকের মতো দুজন অপেক্ষা করছে সে হচ্ছে রংপুরের তারাগঞ্জের আশেপাশের একটা গ্রাম থেকে আসা একটা কাজের মেয়ে।

শাফিয়া রহমানের অফিসের এক পিয়নের মাধ্যমে যোগাযোগ। মেয়েটির গ্রামের মেম্বার মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে। কাজের মেয়ে সাপ্লাই দেয়া বোধয় তার পুরনো পেশা। মেম্বার বিনয়ে গলিত হয়ে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে চলে গেল কিন্তু চাহনি দেখে অতি ধুরন্ধর মনে হলো তাকে। মেয়েটিকে বিধ্বস্ত লাগছে। ক্লান্ত বোধয়। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে শাফিয়ারও। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “পরে কথা হবে। বিশ্রাম কর।”

মেয়েটি কিছু বলল না। বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকলো। শাফিয়া শুয়ে পড়েলন।

ফুলীর মা শাসাতে শুরু করে, “ঐ ছেমরি! ঠিকমতো চলবি। কুন তেরিমেরি করবি না। ফল বালা হইব না কইলাম!” মেয়েটি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে।

ফুলীর মা আবারো বকবক শুরু করে- “ তর নামই ত জিগাইলাম না। নাম দিয়া কাম কী! ছেরি কইলেই সাড়ে। যাকগা, ক দেহি তর নাম কী!”

মেয়েটি কথা না বলে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকে মহিলার দিকে।

রাগ উঠে যাচ্ছে ফুলীর মায়ের,“ঐ ছেমরি, নাম কস না কেন? তুই গুঙী?” মেয়েটির চোখ মিটিমিটি হাসে। ফুলীর মাকে রাগাতে পেরে সে বোধয় প্রীত। তেড়ে আসে ফুলীর মা, “কতা না কইলে মুখের মধ্যে চিপা দিমু!”

মেয়েটি ধারালো দৃষ্টি দিয়ে মাথা খানিকটা দুলিয়ে বললো, “হামার নাম জ্বীন।” ফুলীর মায়ের গা ছমছম করে উঠলো। তার মনে হলো মেয়েটির চোখ যেন লাল হয়ে যাচ্ছে; হাসিটা যেন পিশাচের হাসি। হাউমাউ করে উঠলো “ ও আল্লাহ্! এইডা কী কয়? জ্বীন আবার নাম অয়নি মানষের! খালাম্মা গো! শুনেন কতা!”

শাফিয়ার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। আচ্ছাসে বকলেন ফুলীর মাকে তার বোকামি দেখে। বকা খেয়ে ফুলীর মা সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটিকে বলে, “ধানাইপানাই করবিনা আমার লগে। আমি  তর মতো গাইয়া ভূত না! আমি শহরে থাহি বহুত বছর; ব্যারাশ্টো আর প্যাশ দিয়া দাঁত মাজি।”

চলতে থাকে বকবকানি ।

ফুলীর মায়ের কোন কথার জবাব মেয়েটির দিতে ইচ্ছে করে না। দুনিয়ার কারও সাথেই তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘেন্না লাগছে সব কিছুর উপর। বমি বমি ভাব লাগছে। গা ঘিনঘিন অনুভূতি তার সমস্ত গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কারণটা তার বলতেও ইচ্ছে করছে না। ফুলীর মায়ের সাথে উল্টা পাল্টা আচরণ করে সে দুনিয়ার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। ভোরে উঠে বাথরুম ধোয়ার নাম করে ফুলীর মায়ের ব্রাশে হারপিক মাখিয়ে রাখে। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোসল করে আর নীরবে কি সব ভাবে। ওঠার পর ফুলীর মায়ের মুখ ছিলে শেষ। শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড যদিও মেয়েটির কোন বিকার নেই ।

শাফিয়া রহমানের সাথে কথা হলো তার। নাম আসলে জানু। শাফিয়া তাকে বুঝিয়ে বলে লক্ষ্মী হয়ে চলতে।

সারাদিনই জানুর কেমন গা গুলাচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে। সে রান্নাঘরে ঝুড়িতে ছড়িয়ে রাখা জলপাই লবণ দিয়ে খেতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সাবাড় করলো দশটা জলপাই। জলপাই এর বীচি দেখে ফুলীর মায়ের মাথা গরম। এই এতগুলো কাঁচা জলপাই কিভাবে শেষ করে মানুষ। সে কেমন অন্তর্নিহিত কারণ আবিষ্কার করতে চায়। জলপাই ধরতে নিষেধ করলে জানু বমির ভাব দেখিয়ে আরেকটি জলপাই হাতে নেয়। ফুলীর মা সেটা কেড়ে নিলে সে দৌড়ে বাথরুমে বমির শব্দ করে। ফুলীর মা হৈচৈ বাঁধায় “খালাম্মা গো! সর্বনাশ! দ্যাখেন ছেমরি কী করতাছে।” শাফিয়া অবাক হয়, “জানু জলপাই খেলে তোমার কী সমস্যা? ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে এসেছে?”

ফুলীর মা চেঁচিয়ে উঠে, “আরে, খালাম্মা, কিছু বুঝতাছেন না ক্যাড়ে? মাইয়ার রকম সকম বালা না! ক্ষণে ক্ষণে বমি করে, জলপাই খায়; ঝিম মাইরা শুইয়া থাকে। কী কইরা আইছে ক্যাডা জানে!”

শাফিয়া একটু হলেও ধাক্কা খায়। কী বলছে এসব? কী ভয়ংকর কথা! তারপর ভাবে ফুলীর মা বোধয় বেশি বোঝার চেষ্টা করছে। জানুকে প্রশ্ন করে জানলেন সে শুয়ে থাকে কারণ তার ক্লান্ত লাগে, বমি লাগে, পেটে হালকা ব্যথা করে। দুনিয়ার কিছুই তার ভালো লাগে না। তার মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। সব কিছু শুনে তিনি চিন্তায় পড়লেন। বিষয়টি নিয়ে এক ডাক্তার বান্ধবীর সাথে কথা বললেন। চেম্বারে নিয়ে যেতে বললেন। নিজেই আল্ট্রাসনো করবেন। শাফিয়াকে সাবধানও করলেন কোন ঘটনা আছে কিনা খোঁজ নিতে বলে, গ্রামের মেয়ে তো; শিকার হলো কিনা কারও!

শাফিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এ কোন ঝামেলায় পড়লেন ! দুদিন বাদে ছেলে দেশে ফিরলে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান! কত চিন্তা, কত কাজ! সব ছাপিয়ে এই ছোট্ট মেয়ের জীবন নিয়ে  শঙ্কিত হয়ে পড়লেন তিনি। শাফিয়া ফুলীর মায়ের দেয়া মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রেখে জানুর সাথে খোলাখুলি কথা বললেন। বোঝালেন সত্যি কথা না বললে বিপদ হতে পারে; কোন ঘটনা ঘটলে সেটা খুলে বলতে; শাফিয়া তাকে সাহায্য করতে চান।

জানুর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভাবতে গেলে মন কুঁকড়ে যায়; দুনিয়াকে অসহ্য লাগে। ঘিনঘিন লাগে। রাগের চোটে বলে, “কিছু হয় নাই!” শাফিয়া লেগেই থাকে বোঝানোর চেষ্টায়। হঠাৎ মেয়েটা বলে বসে, “কিন্তু আমি তো দৌড় দিসিলাম!” শাফিয়া অবাক হয়, “মানে? কোত্থেকে? খুলে বল!”

জানু লজ্জা পেয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। খুলে বলতে পারে না। চোখের পাতায় ভেসে ওঠে দুঃসহ স্মৃতি। যে মেম্বার তাকে নিয়ে এসেছে তার বাড়িতে কয়েক ঘন্টা থাকতে হয়েছিল তার। সেদিনকার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা তোলপাড় করে দিয়েছে তার জীবনের স্বাভাবিকতাকে। দুপুরে খাওয়ার পর মেম্বারের দুই স্ত্রী বায়না ধরলো তারা গ্রামের এক পড়শির বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান দেখতে যাবে। মা-চাচিরা গোল হয়ে নাচবে আর গাইবে; অন্য গ্রাম থেকে নাচের দলও আসবে। মেম্বার সহজেই অনুমতি দিল তার নিজেরও একটা মিলাদে যেতে হবে বলে। আসরের আযানের আগেই বেরিয়ে গেল মেম্বার। দুই বৌও  বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। জানুরও ইচ্ছে হচ্ছিল যেতে; বলতে পারেনি। মন খারাপ করে কাঁদতে বসে। গ্রামের জন্য মন কেমন করছে। সংসার চালানোর তাগিদটা না থাকলে সে কক্ষনো আসত না বাড়ি থেকে। ভেতর থেকে কান্না আসছে। এমন সময় দরজায় কড়া নড়লো। খুলে দ্যাখে মেম্বার। তার অশালীন চাহনি যেন গিলে খাবে জানুকে। মুখে কুৎসিৎ হাসি। জানুকে সামনে ঠেলে পেছনের দরজাটা লাগিয়ে দিল। পরের স্মৃতিগুলো মনে করতে চায় না।  শুধু আলোহীন বিকেলে বন্ধ বাড়ির দুঃসহ অন্ধকার, নিশ্বাস চেপে ধরা আঠালো গন্ধ, ছুটোছুটি, নিজেকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা। দম বন্ধ হতে চায় এসব ভাবলেই। সে আঁচ করতে পারে মৃত্যুর সময় কত কষ্ট হয়েছিল পাটক্ষেতে পড়ে থাকা তার আপন বড় বোন শানুর।

ঘুমাতে পারছেন না শাফিয়া । ছটফট করছে মন। তিনি নিশ্চিত  কিছু একটা ঘটেছে জানুর জীবনে তবে মাত্রাটা বুঝতে পারছেন না। পৃথিবীটার কী অবস্থা! এরই নাম সভ্যতা? এরা কি মানুষ? নর্দমার কীটগুলোর কোন শাস্তি হয় আদৌ! কেমন করে রক্ষা করবেন এই ছোট্ট কিশোরীকে? অস্থির হয় মন।

বিকেল ৪টায় পৌঁছালেন চেম্বারে। ডা: পারভীন সমস্যার ভয়াবহতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে সত্যি ঘটনা বলতে বলেন। ভড়কে গিয়ে জানু ফস করে বলে ওঠে, “কিন্তু আমি তো দৌড় দিসিলাম।” জানা গেল মেম্বারের এক স্ত্রী ছোট ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফিরেছিল ছেলে কাপড় নষ্ট করায়। আর তাতেই বেঁচে যায় জানু। ডাঃ পারভীন নিশ্চিত হতে পারছেন না কথা সত্য কিনা। তারপর সব ভালো করে চেক করে বললেন আসলে বাজে অভিজ্ঞতার জের ধরে মানসিক শক থেকেই শারীরিক সমস্যাগুলো হচ্ছে । ঘাবড়াবার কিছু নেই । হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন শাফিয়া ।

জানুর কিছুই বুঝতে ইচ্ছে করে না। কিছু ভালো লাগে না। ফুলীর মাকে অসহ্য লাগে। শাফিয়া রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞ হতেও ইচ্ছে করে না। মন চায় সব পুরুষ মানুষের চোখ গেলে দিতে। ঝিম মেরে পড়ে থাকে আর আকাশ পাতাল ভাবে। কোন কাজও করে না। রাগে গজ গজ করে ফুলীর মা। জানুও গালাগাল দেয় উঁচু গলায়। বাসায় এক অসহনীয় পরিবেশ। শাফিয়ার মাথা খারাপ হবার দশা। এক পর্যায়ে তিনি জানুকে বোঝাতে গেলে জানু তার সাথেও খেঁকিয়ে উঠে। চরম রাগ হলো শাফিয়ার। এ কেমন কথা? তার সাথেও বেয়াদবি করতে ছাড়ল না জানু! কৃতজ্ঞতাবোধ বলতে কিছুই নেই জানুর? রাগের চোটে বলেন, ‘‘ঠিকাছে! গ্রামে চলে যেতে চাস তো? তাই হবে! তোকে রেখে আমার যে লাভ হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু না। অশান্তির উৎস হওয়া সত্ত্বেও মানবিক কারণে আমি তোকে মায়া দেখাচ্ছিলাম!”

জানু তার কথা বুঝতে পারে তবু যেহেতু সে চলে যাবার কথা বলেছে সে সেই জেদটাই ধরে রাখে। মুখে কিছু বলে না। শাফিয়ারও জেদ চাপে । জানুর কথামতো বাসে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তই নিলেন যদিও একা পাঠাতে মন সায় দিচ্ছে না।

বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পথে ভাবতে থাকে শাফিয়া, গ্রামে ফিরে যাওয়া মানেই মেম্বারের দখলে চলে যাবে জানুর জীবন। জানু কি তাই চায়? শাফিয়া রহমানের কি উচিত হচ্ছে জেদের বশে মেয়েটিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া?

ওদিকে জানুর মনের ভেতর শত ভাবনা। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? সে কি মেম্বারের প্রলোভনে পা দিতে চাচ্ছে? সংসারের জন্যে চাল, ডাল, কাপড়চোপড় আরও কত কিছুর প্রতিশ্রুতি! এই পাপের পথে সে কি স্বেচ্ছায় পা বাড়াচ্ছে? কেন এমনটা হয়ে গেল?

জানুর ইচ্ছে করে সব জেদ ঝেড়ে খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না সে। বড় রাস্তার আশেপাশে এখানে ওখানে বাসগুলো দাঁড়িয়ে আছে কুমিরের মতো হা করে; যেন এক্ষুনি গিলে খাবে সর্বাঙ্গ। হায়েনার হাসির মতো হর্নের শব্দে দুঃসহ চারিপাশ। অসহ্য  স্মৃতির ধোঁয়ায় গুমোট গরমে গা ঘিনঘিন করা আঠালো গন্ধে বন্ধ হয়ে আসতে চায় নিঃশ্বাস।